সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৬

টোপ | ছোটগল্প

টোপ

মাহবুবুল হক শাকিল |
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
রাশেদুজ্জামান সাহেব চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর দিনগুলো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গিয়েছিল, অনেকটা ব্যস্ত ট্রাফিক জ্যামের রাস্তায় ধুঁকতে থাকা বহু পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় বাসের মতো। যে বাসের না আছে চাকচিক্য, না আছে গতি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অন্য সব নতুন বডির দ্রুতগামী গাড়ির ধুলো খাওয়াটাই হয়ে যায় যার অনিবার্য নিয়তি।
রাশেদুজ্জামান সাহেবকে কাছের মানুষ রাশেদ নামেই চেনে, অফিসের লোকজনের কাছে তিনি ছিলেন জামান সাহেব। আপাতসুখী জামান সাহেব থাকেন তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। দুই ছেলে। দুজনেই বিবাহিত, সন্তানসন্ততির জনক, থাকে বাইরে। বড়টা থাকে কানাডায়, মন্ট্রিয়লে, ছোটটা ফ্রান্সের প্যারিসে। দেশে আসে দুবছর অন্তর। জামান সাহেব থাকেন মিরপুর, পল্লবীতে, হাজার স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাটে। দুজনের জীবন খুব একটা আঁটোসাঁটো মনে হয় না।
স্ত্রী রুহেলা বেগম আছেন তাঁর বাতের ব্যথা আর নানাবিধ হওয়া না-হওয়া অসুখের ভাবনা, নামাজ, জায়নামাজ এবং সন্তানদের চিন্তা নিয়ে। রুহেলার কথার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে ব্যাধি ও নিরাময়ের বাস্তব ও কল্পিত প্রসঙ্গ। স্বল্পভাষী জামান সাহেবের তেমন কোনো বন্ধুও নেই। চাকরিজীবনে অন্য কলিগরা যখন সন্ধ্যার পর অফিসার্স ক্লাবে যেতেন, তখন তিনি ব্যস্ত থাকতেন দুই সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে। ওদের প্রাইভেট টিউটর ছিল না, ক্লাস এইট পর্যন্ত নিজেই পড়িয়েছেন।
অবসরের দিনগুলো যখন নিতান্তই নিরানন্দময়, তখন তাঁকে এক নতুন জগতে প্রবেশ করাল ছোট ছেলে শফি, পেশায় বিজনেস এক্সিকিউটিভ। বাবাকে শিখিয়ে দিল ফেসবুক কীভাবে চালাতে হয়। নিজেই অ্যাকাউন্ট খুলে বাবার সামনে মেলে ধরল তথ্য কারিগরির অদেখা ভুবন। জামান সাহেব এখন প্রায়ই সময় করে ফেসবুকে বসেন। দুই ছেলে আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে চ্যাট করেন। কিন্তু প্রায়ই বলে-ব্যাটে হয় না। বড় ছেলে বাস করে পৃথিবীর আরেক গোলার্ধে, দিনরাত পুরো উল্টো চাকায় ঘোরে। প্রেশারের ট্যাবলেট খেতে হয় বলে বেশি রাত জাগা বারণ। ছোট ছেলের সঙ্গে অবশ্য সময়ের দূরত্ব সে তুলনায় কম। তার সঙ্গেই কথা হয় বেশি।
জামান সাহেবের ফেসবুক প্রোফাইল ছবিতে ঈদের দিনের টুপি-পাঞ্জাবি পরা একটি ছবি, কাভার ছবিতে তাঁর চার নাতি-নাতনি, একসঙ্গে, হাসছে। বড় ছেলে গেল বছর যখন সপরিবার তার ছোট ভাইয়ের কাছে প্যারিসে বেড়াতে গিয়েছিল, তখনকার তোলা। রুহেলা বেগম অতশত বোঝেন না। মাঝেমধ্যে কম্পিউটারে এসে ছেলে আর নাতি-নাতনিদের ছবি দেখলেই খুশি।
দুই ছেলে বা নাতি-নাতনিকে অনলাইনে না পেলে জামান সাহেবের সময় আর কাটতে চায় না। পরিচিত-অপরিচিত কয়েকজনকেই বন্ধু করেছেন ফেসবুকে। তারা হয়তো বেশিক্ষণ তাঁর মতো বুড়োর সঙ্গে কথা বলে মজা পায় না। অবশ্য একবার এক মেয়ে, বয়স কত হবে, বড়জোর একুশ পেরিয়েছে, জামান সাহেবকে ফেসবুকে বন্ধু করল। মেয়েটি বেশ রোমান্টিকভাবে চ্যাট করে। জামান সাহেবের মন্দ লাগে না মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে। একদিন মেয়েটি বলে, তার মোবাইলের টাকা শেষ। জামান সাহেব যদি ওকে পাঁচ শ টাকা ফ্লেক্সিলোড করেন, তবে তার খুব উপকার হয়। জামান সাহেবের মায়া লাগে। আহা! বেচারা!
তিনি মেয়েটির ফোন নম্বর নিয়ে পাড়ার দোকান থেকে তাকে ফ্লেক্সি পাঠান। সে পেল কি না নিশ্চিত হতে ফোন করেন মেয়েটির নম্বরে। কয়েকবার রিং হতেই একটি পুরুষকণ্ঠ হ্যালো বলে ওঠে। জামান সাহেব মেয়েটির নাম বলে জিজ্ঞাসা করেন এটি ওর নম্বর কি না। পুরুষটি বলে, না। জামান সাহেব আবারও নম্বরটি বলে প্রশ্ন করেন, এটা কি সেই নম্বর কি না। পুরুষটি বলে, নম্বর ঠিক আছে। জামান সাহেব বলেন, আমি তো ফ্লেক্সি করলাম এই নম্বরে পাঁচ শ টাকার, ওই মেয়েটির কথায়। এবার পুরুষ কণ্ঠ বিশ্রীভাবে হেসে ওঠে। বলে, ‘ব্যাটা, বুড়ো খাটাশ, ফেসবুকে ভুয়া ছবি আর ফেইক অ্যাকাউন্ট দিয়া আমি তোরে আবুল বানাইছি।’ জামান সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়। পাঁচ শ টাকার শোকে নয়, মানুষ কেন মানুষের বিশ্বাসকে অপমান করে, তা ভেবে। বিষণ্ন জামান সাহেব বাসায় ফিরে চুপচাপ বসার ঘরের সোফায় বসে থাকেন। নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। সে রাতে তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তিনি ফেসবুকেও বসেন না।
পরদিন জামান সাহেব তাঁর নিচতলার ফ্ল্যাটের আসগর সাহেবের ছেলে কিশোরকে বাসায় ডাকেন। কিশোর কাজ করে একটি আইটি ফার্মে। তার কাছ থেকে হাতে-কলমে জেনে নেন কীভাবে ফেসবুক আইডি খুলতে হয়, পাসওয়ার্ড বদলাতে হয়। তিনি যে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মালিক, তা কিশোরের কাছে চেপে যান। কিশোর বেশ খুশি গলায় বলে, ‘ভালোই হবে। চাচা, এখন ভাইয়াদের সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাট করতে পারবেন।’ জামান সাহেব কিছুই বলেন না। শুধু একটুখানি মুচকি হাসেন।
সে রাতেই জামান সাহেব একটি অ্যাকাউন্ট করেন। নিজের নাম দেন জ্যাক রকার। ফেসবুক থেকে অনেক ঘেঁটে একটি হ্যান্ডসাম, পশ্চিমা ধাঁচের চেহারার ছেলের ছবি জুড়ে দেন প্রোফাইল পিকচার হিসেবে। কাভার ছবি দেন একটি আমেরিকান রকব্যান্ডের, যাদের গান শোনা তো দূরের কথা, জামান সাহেব এদের নামও তাঁর বাপের জন্মে শোনেননি।
জামান সাহেবের এখন দুটো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। নিজের নামের অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি ছেলে আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কথা বলেন। বেশি সময় সেখানে থাকেন না। লগ-আউট করে চলে যান অন্য অ্যাকাউন্টে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর অনেক বন্ধু হয়ে যায়। সবাই জ্যাক রকারের সমবয়সী। তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন দিনের অনেকটা সময়। জ্যাক রকারের পোশাক পরার পর রাশেদুজ্জমান সাহেবের পুরোনো রদ্দিমার্কা বাসের মতো জীবন যেন ফেরারি মডেলের স্পোর্টস কারের গতি পায়।
তাঁর এখন সময় কাটে জ্যাক রকারের বন্ধুদের সঙ্গে ইন্টারনেটে আড্ডা মেরে। তাদের ওয়ালে নিত্যনতুন ফ্যাশনের গল্প, নতুন নতুন সব ইংরেজি-বাংলা শব্দের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। হ্যাই ডুড, ক্র্যাশ খাওয়া, মাইরালা—এসব শব্দ ধীর ধীরে তার চোখ-সওয়া হয়ে উঠতে থাকে। জামান সাহেব মাঝেমধ্যে তাঁর তারুণ্যে শোনা বিটলসের গান শেয়ার করেন জ্যাকের ওয়ালে। অবাক হয়ে দেখেন, এরা বিটলসও শোনে। এরা ১৯৭১ সালের ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচিত। বেশ ভালো লাগতে থাকে জামান সাহেবের।
আবার মাঝেমধ্যে কেউ কেউ জ্যাক রকারের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠায়। তিনি লাইক দেন। হঠাৎ করেই একসময় তিনি লক্ষ করেন, এসব দাওয়াত বেড়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বিভিন্ন জেহাদি লিংকও পাঠায় তাঁর ওয়ালে। মাঝেমধ্যে তিনি সেসব লিংক ওপেন করেন। কৌতূহলী হয়ে দেখেন, র্যাডিক্যাল ইসলাম কীভাবে কিছু কিছু তরুণকে আচ্ছন্ন করছে। মাঝেমধ্যে চ্যাটে ওদের বোঝাতে চেষ্টা করেন। লাভ হয় না, ওরা খেপে যায়। তিনিও ক্ষান্ত দেন। এভাবেই প্রজাপতির মতো উড়ে যেতে থাকে জ্যাক রকার ওরফে রাশেদুজ্জামান সাহেবের দিন।
একদিন তিনি টেলিভিশন খুলে স্ক্রলে দেখেন প্যারিসে হামলা হয়েছে। দ্রুত রিমোট দিয়ে চ্যানেল বদলে চলে যান বিবিসিতে, সেখান থেকে সিএনএনে। তাঁর শরীর কাঁপতে থাকে। শোবার ঘরে রুহেলা বেগমকে বলেন এই ভয়াবহ ঘটনার খবর। রুহেলা বেগম বসে যান জায়নামাজে। কাঁপা হাতে টেলিফোন ঘোরান জামান সাহেব। ছোট ছেলের প্যারিসের নম্বরে। ফোন বন্ধ। এবার ফোন করেন ছেলের বউয়ের মোবাইলে। তা-ও বন্ধ। নিজেকে দিশাহারার মতো লাগে। ফোন করেন কানাডায়। বড় ছেলেকে। সে ফোন ধরে। বাবাকে সান্ত্বনা দেয়। অপেক্ষা করতে বলে। সে-ও নাকি চেষ্টা করছে। জামান সাহেবের কাছে হঠাৎ করেই চেনা ফ্ল্যাটটা অচেনা মনে হয়। তিনি ঘরের লাগোয়া একচিলতে বারান্দায় গিয়ে মৃত মাছের চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এভাবে সময় গড়াতে থাকে ধীরে, অতি ধীরে। একসময় তাঁর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছেলের গলা, ‘বাবা, চিন্তা কোরো না। আমরা সবাই ভালো আছি। মা কোথায়? মাকে দাও।’
রুহেলা বেগমের কাছে ছুটে যান তিনি। নিঃশব্দে তাঁর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দেন। তারপর আবার বেরিয়ে আসেন বারান্দায়। কার্নিশে দুটো শালিক কিচিরমিচির করছে। আকাশের নীল রংটা তাঁর কাছে একটু বেশিই নীল মনে হয়। তাঁর চোখের কোণে জল। মনে হয়, বেঁচে থাকাটা নেহাতই মন্দ নয়।
২.
জামান সাহেব ভালোই ছিলেন। জ্যাক রকার হয়ে সারা দিন ফেসবুকিং করে সময় কাটাতেন। কিন্তু হঠাৎই তাঁর জীবনটা পাল্টে গেল গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার পর। সেই রাতে তিনি একটিবারের জন্যও দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না। তাঁর চোখজোড়া সারা রাত সাঁটানো ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। এক অজানা অনুভূতির ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল শরীরে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর তিনি আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে গেলেন ফেসবুক নিয়ে। তবে এখন আর গান আপলোড নয়, তিনি খুঁজে খুঁজে বের করতে লাগলেন সেই সব ফেসবুক পেজ, যেখানে জেহাদি কথাবার্তা চলে, আর্টিজানের ঘটনার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়। সেই সব লিংক তিনি সংগ্রহ করেন। তারপর চিঠি লেখেন পুলিশের কাছে, এদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে। শুধু এটি করেই ক্ষান্ত থাকেন না তিনি। এসব পেজে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেন।
ঘটনাটি ঘটে আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের মাস খানেক পর। ফেসবুকে জঙ্গি মতবাদ প্রচারকারী একটি গ্রুপের সঙ্গে রীতিমতো সংঘাত বেঁধে যায় তাঁর। জ্যাক রকারকে ‘নাস্তিক’ বলে গালিগালাজ করে তাঁর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তারা। একপর্যায়ে সামনাসামনি দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। নিষ্ফল ক্রোধে ফুঁসতে থাকেন জামান সাহেব। পরদিন আবার ফেসবুক খুলে তিনি দেখেন, গালিগালাজের বন্যা আরও বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর অবস্থা আর্টিজানের জিম্মিদের মতো হবে বলেও তারা শাসায়। ঠান্ডা মাথায় জামান সাহেব লেখেন, ‘সাহস থাকলে সামনে আসো। কবে, কোথায় বলো?’ কোনো জবাব আসে না। নিজেকে বেশ বীরের মতো লাগে তাঁর। ব্যাটারা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। তিনি ভাবেন, আরেকটু ভয় দেখানো যাক। যত্তসব ইঁদুরের দল! পরদিন আবার ফেসবুকে জবাব খোঁজেন তিনি। নেই, লাপাত্তা সব। জামান সাহেব গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন একবার, বড় ছেলে যখন দেশে এসেছিল, তখন তার সঙ্গে। তিনি সেই রেস্টুরেন্টের নাম দিয়ে লেখেন, ‘সাহস থাকলে আগামীকাল সন্ধ্যা আটটায় এখানে আয়। জানি, তোদের সেই মুরোদ নেই।’
সকালবেলা বাজার শেষ করে ঘরে ফিরেই তিনি ফেসবুক খোলেন। দেখেন, ইনবক্সে লেখা আছে, ‘আমরা আসব। যদি মুসলমানের পয়দা হোস তবে আসিস বাস্টার্ড জ্যাক।’ কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে তাঁর। কি-বোর্ডে আঙুল চাপার সময় লক্ষ করেন, হাত দুটো কাঁপছে। তিনি লেখেন, ‘আমি ঠিক আটটায় থাকব।’ তারপর ফেসবুক বন্ধ করে দেন। শোবার ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। রান্নাঘরে বুয়া কাজ করছে। তার সঙ্গে অসুখ-বিসুখ নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন রুহেলা খাতুন। তিনি সেই আওয়াজে কান পেতে থাকেন।
সন্ধ্যা ছয়টার আগেই জামান সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর পরনে ঘিয়ে রঙের শার্ট, সিনথেটিক। কালো স্ট্রাইপ প্যান্ট, ছোট ছেলে প্যারিস থেকে এনে দিয়েছিল। চকচকে কালো অক্সফোর্ড শু, পলিশ করা। অফিস করার দিনগুলোর মতোই ছিমছাম তিনি পোশাকে। তাঁর এই পোশাকের সঙ্গে বেমানান হাতে ধরে রাখা একটি সবুজ দেড় লিটার স্প্রাইটের প্লাস্টিকের বোতল।
বাসা থেকে নেমে তিনি ধীরেসুস্থে মহল্লার মুদি দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আর একটা লাইটার চাইলেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত দোকানি অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বললেন, স্যার? বেনসন সিগারেট? আপনাকে তো কখনো সিগারেট খাইতে দেহি নাই!’
‘দেখো নাই তো কী হয়েছে? আজ থেকে খাব।’
দোকানি আর কথা বাড়াল না। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার হাতে নিয়ে তিনি দাম মেটালেন। তারপর লাইটারের পুশ বাটনে কয়েকবার চাপ দিয়ে পা বাড়ালেন বড় রাস্তার দিকে।
আটটা বাজার আগেই জামান সাহেব নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেন। কোনো কাস্টমারই নেই। অথচ গেলবার যখন ছেলের সঙ্গে এসেছিলেন, তখন ফাঁকা টেবিল পাওয়াটাই ছিল দুষ্কর। ওয়েটারগুলো একপাশে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। জামান সাহেব ওয়াশরুমের পাশের একটা টেবিল পছন্দ করে বসলেন। একজন ওয়েটার বলল, ‘স্যার, এটা তো টয়লেটের পাশে। আরও ভালো টেবিল আছে।’ তিনি কোনো জবাব দিলেন না। হাতের স্প্রাইটের বোতলটা টেবিলে রাখলেন। আরেকজন ওয়েটার এসে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার, আমাদের এখানে বাইরের বেভারেজ খাওয়া নিষেধ।’ তিনি বললেন, ‘জানি, আমি তোমাদেরটাই নেব।’ তারপর তিনি ছোটবেলার ক্লাসের পড়ার মতো মনোযোগ দিয়ে মেন্যুবুক দেখতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর দুজন এল, মধ্যবয়সী, কাঁচা-পাকা চুল। সামনের দিকের একটি টেবিলে বসল। জামান সাহেবের স্নায়ু টানটান হয়ে উঠল। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। এরাই কি সেই হুমকিদাতা? লোক দুটো তাঁর দিকে তাকালই না। একজনের হাতে একটি প্যাকেট, যা জামান সাহেবের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি দেখলেন, লোকটি প্যাকেট খুলছে। জামান সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কী করবেন। চলে যেতে হলে লোক দুটোর সামনে দিয়েই যেতে হবে। তাঁর পা দুটো কি একটু কাঁপল? তিনি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারার আগেই লোকটার প্যাকেট থেকে বেরোল একটি মদের বোতল। জামান সাহেব ইহজীবনে মদ না খেলেও সিনেমা-টেলিভিশনের কল্যাণে মদের বোতল চেনেন। তাঁর বুক থেকে একটি তৃপ্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। আপনমনেই হাসলেন। ভাবলেন, ভালোই তো নিয়ম। বাইরের বেভারেজ খেতে দেয় না, মদ খেতে দেয়!
দূর থেকে একজন ওয়েটার তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলেন, ছেলেটা খাবারের অর্ডারের অপেক্ষায়। তিনি একটা গ্রিক সালাদ, ল্যাম্বচপ আর ভেজিটেবল স্যুপের অর্ডার করলেন। ওই টেবিলের লোক দুটো ততক্ষণে গ্লাসে মদ ঢেলে চুমুক দেওয়া শুরু করেছে। জামান সাহেব নিশ্চিত হলেন, মধ্যবয়সী এই দুই মাতাল কোনোভাবেই জঙ্গি হতে পারে না।
খাবার চলে এসেছে। ল্যাম্বচপের হালকা পোড়া গন্ধে সুবাসিত চারপাশ। তিনি নজর দিলেন স্যুপের বাটিতে। লাল গাজর, সবুজ ব্রুকলি আর গোল করে কাটা চালকুমড়োর টুকরো স্যুপের জলে ভাসছে। এরই মধ্যে ভেতরে ঢুকল দুটো প্রায়-তরুণ ছেলে। দুজনেরই পরনে হালফ্যাশনের জিনস, পায়ে লোফার জুতো, হাতে ব্রেসলেট, ইংরেজি ডায়ালগ লেখা গোল গলার টি-শার্ট। চটুল ভঙ্গিতে একজন কী যেন বলে উঠতেই আরেকজন হেসে শিস দিয়ে উঠল। নিজের স্যুপের দিকে মনোযোগী হলেন জামান সাহেব। এক টেবিল থেকে ভেসে আসছে দুই মাতালের কষ্টের আলাপ, আরেক টেবিল থেকে দুই তরুণের ইংরেজি মেশানো হালকা ধরনের আলাপ। স্যুপ শেষ করে ল্যাম্বচপের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। তাঁর অন্যমনস্ক চোখ গেল তরুণদের দিকে।
তাহলে কি এরাই? ওই টেবিলেও খাবার চলে এসেছে, সঙ্গে কোক। ওদের চোখের দৃষ্টি মাঝেমধ্যেই ঝিলিক দিচ্ছে। মনে হয় কাউকে খুঁজছে। ওরা যদি জ্যাক রকারকে খোঁজে, তাহলে খুঁজবে ওদের মতোই একটি স্টাইলিস্ট তরুণকে। একজন আবার বাইরে গেল। ফিরে এসে সঙ্গীকে কী যেন বলল। এবার সঙ্গী উঠে বাইরে গেল। আবার ফিরে এল। তিনি ল্যাম্বচপ চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে নিতান্ত নিরাসক্তভাবে ওদের ত্রস্ততা দেখছেন। জামান সাহেব ওয়েটারের কাছে কোক চাইলেন। ঠান্ডা কোকে চুমুক দিতে দিতে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর ধীর পায়ে উঠে গেলেন ওয়াশরুমের দিকে। তাঁর হাতে সঙ্গে করে নিয়ে আসা দেড় লিটারের স্প্রাইটের বোতল। তরুণদের মধ্যে একজন কি তাঁর দিকে তাকাল? এখন আর ভাবার সময় নেই।
ঘড়ির চাকা যেন থেমে আছে অনন্তকাল ধরে। মিনিট তিনেক পর জামান সাহেব বেরোলেন ওয়াশরুম থেকে। তাঁকে দেখে উন্মাদের মতো মনে হচ্ছে। মাথা-শরীর—সব বৃষ্টিতে ভেজা কাকতাড়ুয়ার মতো। ফোঁটায় ফোঁটায় তরল ঝরছে। দুই টেবিলের সবাই, ওয়েটাররা প্রত্যেকেই অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বুনো বাইসনের গতিতে দুই তরুণের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এক লহমারও কম সময়ে হাতের লাইটার জ্বালিয়ে দিলেন গায়ের সিনথেটিক শার্টে। কেরোসিনের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দুই তরুণ দৌড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু অসুরের শক্তি দিয়ে জামান সাহেব ওদের জড়িয়ে ধরলেন।
জামান সাহেবের শরীর জ্বলছে। মাথার চুল আগুনে পুড়ে কেমন যেন কটকটে শব্দ হচ্ছে। আগুন ধরে গেছে দুই তরুণের শরীরে। তারা প্রাণপণে নিজেদের ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মুহূর্তের জন্য জামান সাহেবের মনে হলো, তিনি কি কোথাও ভুল করেছেন? যদি এরা সেই জঙ্গি না হয়ে থাকে, তাহলে পরকালে গিয়ে কী জবাব দেবেন? তাঁর দগ্ধ হাতের বাঁধন কিছুটা আলগা হতেই একটি তরুণ ফসকে বেরিয়ে গেল। ছেলেটির আগুনে পোড়া হাত জিনসের লম্বা পকেটে। বেরিয়ে এল একটি ছুরি, অনেকটা কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানোর ছুরির মতো। ছুরি ধরা আগুনে পোড়া হাত তাঁর বুকের দিকে এগোচ্ছে। রাশেদুজ্জমানের মুখে একটুকরো স্মিত হাসির রেখা।
নাহ্। তিনি ভুল করেননি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...