বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ঝরাপালক | কাব্যগ্রন্থ | জীবনানন্দ দাশ

অস্তচাঁদে

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘবৌ’র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে’-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে’ প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!

সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে’ ফিরে’ ফিরে’
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে
আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক’রেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!
আমি ছিনু ‘ক্রবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স্’-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!
স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!
বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!

আমি কবি– সেই কবি– 

আমি কবি– সেই কবি–
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!
স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা–
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!
ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,–
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!
বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প’ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!

আলেয়া 

নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
-হেথা, গৃহবাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,
ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা
চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি!
আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী
ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার সাগরে!
ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের পরে
নিশি নেমে আসে গাঢ়-স্বপনঙ্কুল!
শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল
বনমালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে!
বেণুবনশাখে কোন্‌ পেচকের রবে
চমকিছে নিরালা যামিনী!
পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগকামিনী
আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়!
শ্মশানশয্যায়
নেভ-নেভ কোন্‌ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে
ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে!
নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে
স্বপ্নের বুদ্‌বুদে
বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল-
হে অনল-উন্মুখ, চঞ্চল
উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি
সন্তরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি
কোন্‌ দূর কামনার পানে!
ঝলমল দিবা অবসান
বধির আঁধারে
কান্তারের দ্বারে
একি তব মৌন নিবেদন!
-দিগভ্রান্ত-দরদী-উন্মন!
পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে
তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠে নি তো জ্বলে
আকাঙ্কার উলঙ্গ উল্লাসে!
জনতায়-নগরীর তোরণের পাশে,
অন্তঃপুরিকার বুকে, মণিসৌধসোপানের তীরে,
মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়স্কান- খনির তিমিরে
যাও নি তো কভু তুমি পাথেয় সন্ধানে!
ভাঙা হাটে-ভিজা মাঠে-মরণের পানে
শীত প্রেতপুরে
একা একা মরিতেছ ঘুরে
না জানি কী পিপাসার ক্ষোভে!
আমাদের ব্যর্থতায়, আমাদের সকাতর কামনায় লোভে
মাগিতে আস নি তুমি নিমেষের ঠাঁই!
-অন্ধকার জলাভুমি কঙ্কালের ছাই,
পল্লীকান্তারের ছায়া-তেপান্তর পথের বিস্ময়
নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়
করিয়াছে বিমনা তোমারে!
রাত্রি-পারাবারে
ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি!
হেমন্তের হিম পথ ধরি,
পউষ, আকাশতলে দহি দহি দহি
ছুটিতেছ বিহ্বল বিরহী
কত শত যুগজন্ম বহি!
কারে কবে বেসেছিলে ভালো
হে ফকির, আলেয়ার আলো!
কোন্‌ দূরে অস-মিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া
চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া!
সে কোন্‌ রাত্রির হিমে হয়ে গেছে হারা!
নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,
আঁধার সাহারা!
আজও তব লোহিত কপোলে
চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতেছে জ্ব’লে
অনল-ব্যথায়!
চ’লে যায়-মিলনের লগ্ন চ’লে যায়!
দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি
অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি!
ছলাময় আকাশের নিচে
লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে
ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার
অগ্নি অভিসার!
বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি,
অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি, পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে।

একদিন খিজিনু যারে-

একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে, কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে!
-যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুজিয়াছিনু ঝরঝর
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা@
-শুধু শেষ নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ
গাগরীর কোলে তার উত্থলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি, আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো আধো কথা!
আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ!
মাহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান, অঙ্গার সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্‌মর্‌ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্‌ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো
মোর কেঁদে মরে মন!

ওগো দরদিয়া 

-ওগো দরদিয়া
তোমারে ভুলিবে সবে, যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া;
ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে
কে জানে রহিবে কোথা নিশিভারে নেশাখোর আঁখি তব বুজে!
-হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে
তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে!
চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে,
গীতিহারা প্রাণ তবে হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে!
হয়তো বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে
ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে শিশিরের দলে;
হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি রবে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা-
তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ-নীহারিকা-তারা,
তোমারে চিনিবে শুধু প্রেম জোছনা-বধির জোনাকি!
তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি
তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন-আলোহারা,
তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা!
কিংবা কেহ চিনিবে না, হয়তো বা জানিবে না কেহ
কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ!
-হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান’শালে যাহাদের সনে,
তোমার বিষাদ-হর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে,
যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি
তোমারে ভুলিবে তারা- ভুলে যাবে সব কথা, সবটুকু স্মৃতি!
নাম তব মুছে যাবে মুসাফের-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি
নোনা ধরা দেয়ালের বুক থেকে খসে যাবে কখন না জানি!
তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি,
দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি!
তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে
মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে!
পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন,
কোথা গেছে ইয়োসোফ্‌ জানে না সে, জানে না সে গিয়েছে কখন।
জানে না যে, অজানা সে, আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে-
জানে না রে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে!
জানিতে চাহে না কিছু-ঘাড় নিচু করে কে বা রাখে আঁখি বুজে
অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে!
যৌবনের কোন্‌ এক নিশীথে সে কবে
তুমি যে আসিয়াছিলে বনরানি। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে
তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি
তুমি যে ভরিয়াছিলে-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ, গেছে ফুরায়ে তলানি।
তবু তুমি আসিলে না, বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়!
চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়-
তুমি তাহা জানিলে না-চলে গেছে মুসাফের
কবে ফের দেখা হবে আহা
কে বা জানে! কবরের পরে তার পাতা ঝরে, হাওয়া কাঁদে হা হা!

কবি 

ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপনে!
নিরালায় সুর সাথি, বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
মানুষ দেখে নি মোরে কোনোদিন, আমারে চেনে নি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায় নি মোর চারি পাশে-
শুধায় নি কেহ কভু-আসে কি রে,- সে কি আসে-আসে।
আসে নি সে ভরাহাটে-খয়াঘাটে-পৃথিবীর পসরায় মাঝে
পাটনী দেখে নি তারে কোনোদিন-মাঝি তারে ডাকে নিকো সাঁঝে।
পরাপার করে নি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-
চেনা-চেনা মুখ সবই-সে যে সুদুর-অজানা!
করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
রূপসাগরের মাঝে কোন্‌ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;
খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!
হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধুটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে-তার সুর, দুপুর আকাশে
ঝরাপাতাভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে, জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পুবালি হাওয়ায়!
হয়তো দেখেছ তারে ভুতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের পরে
নিভে যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে!
শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় সেই জোছনা ভাসে
তারই বুকে চুপে চুপে কবি আসে সুর তার আসে।
উস্‌খুস্‌ এলো চুলে ভরে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-
তারই পাশে সুর ভাসে অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!
বালুঘড়িটির বুকে ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে, অকাজে!
ঘুমকুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি, মধুমাছি,ঘাস
হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী সাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,
তেঁতুলের শাখে শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!
জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে-
আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে-
জ্বলে ওঠে আলোয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি।
আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্‌ পাষাণী!
জানে না তো কী যে চায়- কবে হায় কী গেছে হারায়ে।
চোখ বুজে খোঁজে একা-হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা।-কাঁদে হা হা পুরের বাতাস,
শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারই লাগি মুখ তোলে কোন মৃতা-হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,
তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়াপুত্তলিকা!

কিশোরের প্রতি

যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালো নি অধরে তব, ধরা মোহিনীর
    উর্দ্ধফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসেনি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি’,
চুমিয়া-চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালেনিক’ বাসনার বধু
         অন্তরের পান পাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব,
         অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে’ সাজো নি উদাসী।
ধবল কালোর দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান।
অপরূপ রূপ পরীস্থান
         দিগন্তের আগে
তোমার নির্মেঘ-চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশ-কুসুম-বীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া,       
         উধাও হও না তুমি আলেয়ার পিছে
ছলাময় গগনের নিচে!
-রূপ পিপাসায় জ্বলি’ মৃত্যুর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
    করোনিক’ করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি’
         সাজনিক’ নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিক’ তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল,
রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজো রাণী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজো দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন!
কারাগার নাহি তব, নাহিক বন্ধন;
    দীঘল পতাকা, বর্শাত ন্দ্রাহারা প্রহরীর লওনি তুলিয়া,
-সুকুমার কিশোরের হিয়া!
-জীবন-সৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
    বক্ষে তব নাচেনিক’ যৌবনের দুরন্ত জলধি;
    শূল-তোলা শম্ভুর মতন
        আস্ফালিয়া ওঠে নাই মন
মিথ্যা বাধা বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
        তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিক’ জ্বলি’
কক্ষচ্যুত উল্কাসম পড়েনিক’ স্খলি’,
        কুজ্‌ঝটিকা আবর্ত্তের মাঝে
             অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
        সব বিঘ্ন সকল আগল
             ভাঙিয়া জাগোনি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
    দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাওনি প্রাণে!
নিঃস্ব দুটি অঞ্জলির আকিঞ্চন মাগি’
সাজোনিক দিক্‌ভোলা দিওয়ানা বৈরাগী!
    পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
    বাজাওনি শ্মশান-ডমরু!
জ্যোৎস্নাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
    চক্ষে তব জাগেনি কিশোর!
    আঁধারের নির্ব্বিকল্প রূপ,
    স্পন্দহীন বেদনার কূপ
    রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মুখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল-সুন্দরীর বেশে;
    নিত্য বেলা শেষে
    যেই পুষ্প ঝরে,
যে-বরহ জাগে চরাচরে
    গোধূলির অবসানে শ্লোক-ম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে;
আকাঙ্ক্ষার অগ্নি দিয়া জ্বাল নাই চিতা,
    ব্যথার সংহিতা
        গাহো নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি
    জ্বলন্ত নিষ্ঠুর!
নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যু প্রেতপুর,
    ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি’!
    সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী
    মলিন করেনি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করেনি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদ্‌ভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজো ঢালো, বন্ধু, ঢালো

চলছি উধাও 

চলছি উধাও, বল্গাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটে শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে! কোন্‌ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি! -আঁধার আলোর সাগরশেষে প্রেতের মতো আসছে ভেসে! আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে, যেদিন আমি জেগেছিলাম, সেও জেগেছে আমার মনে! আমার মনের অন্ধকারে ত্রিশূলমূলে, দেউলদ্বারে কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ পূজার পুষ্প ঢেলে! স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, আমায় পেলে! রাত্রিদিবার জোয়ার স্রোতে নোঙরছেঁড়া হৃদয় হ’তে জেগেছে সে হালের নাবিক চোখের ধাধায় ঝড়ের ঝাঁঝে মনের মাঝে মানের মাঝে আমার চুমোর অন্বেষণে প্রিয়ার মতো আমার মনে অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে, চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রুপাথার-কূলে! ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে হাতটি রেখে হাতে! দেখিনি তার মুখখানি তো, পাইনি তারে টের, জানি নি হায় আমার বুকে আশেক-অসীমের জেগে আছে জনমভোরের সূতিকাগার থেকে! কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে! সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি! জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি গুঞ্জরিয়া এল-গেল কত গানের রানি, নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি! -ফুলের ফাগে বেহুঁশ হোলি নাকি! হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে! -জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে ঘায়েল হয়ে ফিরল আমার বুকের কেরাভেন- আকাশ-চরা শ্যেন! মরুঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি ইবলিশেরই সঙ্গে তাহার লড়াই-হল শুরু! দরাজ বুকে দিল্‌ যে উড়–উড়-! ধূসর ধু ধু দিগন্তরে হারিয়ে যাওয়া নার্গিসেই শোভা থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা! অলীক আশার, দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি, ঝড়ের ঝুঁটির পরে! পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটকে কারাগারে ভেঙে শিকল ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার চলল সে যে ছুটে! শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে- চুলের ঝুটি ধরল কে তার মুঠে! বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে, হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে! দুশমন কে পথের সুমুখে -কোথায় কে বা! এ কোন মায়া মোহ এমন কার! বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার! মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে- সে কোন সুদূরে তারার আলোরে থেকে মাথার পরের খা খা মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রাপথে কে রে! কী তৃষা তার! কী নিবেদন! মাগছে কিসের ভিখ্‌! উদ্যত পথিক হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে- আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়! -এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়! পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি আজকে নিল ডাকি হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে! মড়ার খুলি-পাহাড়প্রমাণ হাড়ে বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা! আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা, এক সোজা চুম্বকেরই ধ্বংসগিরির পানে, নোঙরহারা মাস্তুলেরই টানে! প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি, জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী! জানে কি সে ভোরের আকাশ, লক্ষ তারার আলো তাহার মনের দূয়ারপথেই নিরিখ হারালো! জানি নি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে কোন্‌ দিওয়ানার সারেং কাঁদে নয়নে নীর ঝরে! কপোত-ব্যথা ফাটে রে কার অপার গগন ভেদি! তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি কোন্‌ সে অসীম আসি! লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি প্রেমের খবর পুছে কবের থেকে কাঁদতে আছে- ‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’

চাঁদিনীতে

বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো; চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো! সে যে জানে কত পাথারের কথা, কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি! কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জোছনা, শুক্লা তিথি! হয়তো সেদিনও আমাদেরই মতো পিলুবারোয়ার বাঁশিটি নিয়া ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া! হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়, সবজি ক্ষেত! হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে এমনি কোন এক চাঁদের আলোয়-মরু ওয়েসিসে তরুর মূলে! বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে এমনি কোন-এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে! কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া! তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড়- পাতা উঠিত বাজি, তাদের শিয়রে দুলিত জোছনা, চাঁচর-চিকন পত্ররাজি! দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনাণীর লতা-পল্লব ঘিরে চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া-এল-বল্লভ-এল রে ফিরে!’ তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি, নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি-চাঁদিনী-শরাব, সুরার শিশি! সেদিনও এমনি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি, হয়তো সেদিনও ফুটেছে মোতিয়া-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাতি! হয়তো সেদিনও নেখাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে, হয়তো সেদিনও আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে! হয়তো সেদিনও এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে হয়তো সেদিনও ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া সরোর শাখে, হয়তো সেদিনও পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে! হয়তো সেদিনও পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে, হয়তো সেদিন মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে! হয়তো সেদিনও মাণিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্‌ফট্‌ দুটি পাখার বেগে! হয়তো সেদিনও খুর খুর করে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে ঘন মেহগিনি টার্পিন তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁেড়! হয়তো সেদিনও জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী! শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহর্ম্যের তোরণে গিয়া পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো! অলিভকুঞ্জে হা হা করে হাওয়া কেঁেদছে কাতর যামিনী ভরি! ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে মার্টিল পাতা পড়েছে ঝরি’! উইলোর বন উঠেছে ফুঁপায়ে-ইউ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে, তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে! কোন্‌ গ্রীস কোন্‌ কার্থেজ, রোম ক্রবেদুর যুগ কোন,- চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর শফরে বেড়ায় মন! জানি না তো কিছু-মনে হয় শুধু এমনি তুহিন চাঁদের নিচে কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হয়ে গেছে কত কী যে! কত যে শ্মশান-মশান কত যে-কত যে কামনা পিপাস-আশা অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!

ছায়া-প্রিয়া 

দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ গান কে গাহে, গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না! সার্সি ঘরের উঠছে বেজে উঠছে কেঁপে পর্দা! বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে জল-ডাহুরের বুকের কাছে; এ কোন্‌ বাঁশি সার্সি বাজায় এ কোন হাওয়া ফর্দা দেয় কাঁপিয়ে পর্দা! নূপুর কাহার বাজল রে ঐ! কাঁকন কাহার কাঁদল পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া মায়ার মিলন ফাঁদল কাঁকন যে তার কাঁদল! খসখসাল শাড়ি কাহার! উস্‌খুসাল চুল গো! পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে: জুল্‌পি কাহার উঠল দুলে! দুলল কাহার দুল গো! উস্‌খুসাল চুল গো! কাঁদছে পাখি পউষনিশির তেপান্তরের বক্ষে! ওর বিধবা বুকের মাঝে যে গো কার কাঁদন বাজে! ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে, নিদ্‌ নাহি মোর চক্ষে! তেপান্তরের বক্ষে! এল আমার ছায়া-প্রিয়া, কিশোরবেলার সই গো! পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; মনের মধূ-মনোরমা- কই গো সে মোর কই গো! কিশোরবেলার সই গো! ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে! গান কে গাহে, গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে বনের ছায়ায়-মাঠের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না!

ডাহুকী

মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী- নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী বিজন তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে বনচ্ছায়া অন্তরালে তরল তিমিরে! আকাশে মন’র মেঘ, নিরালা দুপুর! -নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষনে ক্ষনে ক্ষণে! সে কোন পিপাসা কোন ব্যথা তার মনে! হারায়েছে প্রিয়ারে কি? অসীম আকাশে ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে? বাঞ্ছিত দেয় নি দেখা নিমেষের তরে!- কবে কোন রুক্ষ কাল বৈশাখীর ঝড়ে ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি! -নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী গেয়ে যায়; সুপ্ত পল্লীতটিনীর তীরে ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে! পল্লবে নিস্তব্ধ পিক, নীরব পাপিয়া, গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিণী গান! আকাশে গোধূলি এল-দিক্‌ হল ম্লান, ফুরায় না তবু হায় হুতাশীর গান! সি-মিত পল্লীর তটে কাঁদে বারবার, কোন্‌ যেন সুনিভৃত রহস্যের দ্বার উন্মূক্ত হল না আর কোন্‌ সে গোপান নিল না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন!

দক্ষিণা

প্রিয়ার গালেতে চুমো খেয়ে যায় চকিতে পিয়াল রেণু!- এল দক্ষিণা-কাননের বীণা, বনানীপথের বেণু! তাই মৃগী আজ মৃগের চোখেতে বুলায়ে নিতেছে আখিঁ, বনের কিনারে কপোত আজিকে নেয় কপোতীরে ডাকি! ঘুঘুর পাখায় ঘুঙুর বাজায় আজিকে আকাশখানা,- আজ দখিনার ফর্দা হাওয়ায় পর্দা মানে না মানা! শিশিরশীর্ণা বালার কপোলে কুহেলির কালো জাল উষ্ণ চুমোর আঘাতে হয়েছে ডালিমের মতো লাল! দাড়িমের বীজ ফাটিয়া পড়িছে অধরের চারি পাশে আজ মাধবীর প্রথম উষার, দখিনা হাওয়ার শ্বাসে! মদের পেয়ালা শুকায়ে গেছিল, উড়ে গিয়েছিল মাছি, দখিনা পরশে ভরা পেয়ালার বুদবুদ্‌ ওঠে নাচি! বেয়ালার সুরে বাজিয়া উঠিছে শিরা-উপশিরাগুলি! শ্মাশানের পথে করোটি হাসিছে-হেসে খুন হল খুলি! এস্রাজ বাজে আজ মলয়ের চিতার রৌদ্রতপ সুরের সুঠোমে নিভে যায় যেন, হেসে ওঠে যেন শব! নিভে যায় রাঙা অঙ্কারমালা বৈতরনীর জলে, সুর-জাহ্নরী ফুটে ওঠে আজ মলয়ের কোলাহলে! আকাশ শিথানে মধু পরিণয়-মিলন বাসর পাতি হিমানীশীর্ণ বিধবা তারারা জ্বলে ওঠে রাতারাতি! ফাগুয়ার রাগে-চাঁদের কপোল চকিতে হয়েছে রাঙা! হিমের ঘোমটা চিরে দেয় কে গো মরমস্নায়ুতে দাঙা! লালসে কাহার আজ নীলিমার আনন রুধির লাল- নিখিলের গালে গাল পাতে কার কুঙ্কুম ভাঙা গাল! নারাঙ্গি ফাটা অধর কাহার আকাশ বাতাসে ঝরে! কাহার বাঁশিটি খুন উথলায়- পরান উদাস করে! কাহার পানেতে ছুটিছে উধাও শিশু পিয়ালের শাখা! ঠোঁটে ঠোঁট ডলে- পরাগ চোঁয়ায় অশোক ফুলের ঝাঁকা! কাহার পরশে পলাশবধুর আঁখির কেশরগুলি মুদে মুদে আসে-আর বার করে কুঁদে কুঁদে কোলাকুলি! পাতার বাজারে বাজে হুল্লোড়-পায়েলার রুণ-রুণ, কিশলয়দের ডাশা পেষে কে গো-চোখ করে ঘুমঘুম! এসেছে দখিনা-ক্ষীরের মাঝারে লুকায়ে কোন্‌-এক হীরের ছুরি!- তার লাগি তবু ক্ষ্যপা শাল নিম, তমাল বকুলে হুড়াহুড়ি! আমের কুঁড়িতে বাউল বোলতা খুনসুড়ি দিয়ে খসে যায়, অঘ্রাণে যার ঘ্রাণ পেয়েছিল, পেয়েছিল যারে পোষলায়, সাতাশে মাঘের বাতাসে তাহার দর বেড়ে গেছে দশগুণ- নিছক হাওয়ায় ঝরিয়া পড়িছে আজ মউলের কষগুণ! ঠেলে ফেলে দিয়ে ণীলমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড় দখিনার মুখে রসের বাগান বিকায়ে দিতেছে ক্ষীর! এসেছে নাগর- যামিনীর আজ জাগর রঙিন আঁখি,- কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি- আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া, মদঘূর্ণনে হায়! নিশীথের স্বেদসীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়! রূপসী ধরনী বাসকসজ্জা, রূপালি চাঁদের তলে বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে! রোল উতরোল শোণিতে শিরায়- হোরীর হা রা রা চিৎকার মুখে মুখে মধু- সুধাসীধু শুধু তিত্‌ কোথা আজ- তিত্‌ কার! শীতের বাস্তুতিতে ভেঙে আজ এল দক্ষিণা মিষ্টি মধু মদনের হুলে ঢুলে ঢুলে ঢুলে হুশহারা হল সৃষ্টি বধূ!

দেশবন্ধু 

বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা অশান্ত সন্তান ওগো, বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদীমাতা। কাল বৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব উত্তাল ঊর্মির তালে-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি, ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী। স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি, এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ–ক্লৈব্যের সংহারী। ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর, ভেঙেছিলে ধূলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর, ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভান্ড তীব্র দর্পে, বৈরাগের রাগে, দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে-পৃথী-পুরোভাগে। নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাবগঙ্গোত্তরী আর্ত অর্স্পশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি; বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী। এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ, শানি-প্রিয় মুমূর্ষৃর শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ গান্ডীবের টঙ্কারেতে মুহুর্মুহু বলেছিলে, আশি আমি আছি! কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী। ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভেলির সম, অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম। ছিলে তুমি রূদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে, অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে- অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে। ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি। ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে উন্মত্ত ঝটিকাসম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে; শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশল্যকরণী। ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে শবসাধকের বেশে-সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে। রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী; কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি। বিবিবশে দূরগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক, অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোকে। মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল, গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন-উচ্ছ্বাসউচ্ছল। যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে, তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে। অর্চনার হোমকুন্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি, বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি। গৌরকানি- শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা চুপে চুপে রেখে এল পূঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা।

নাবিক

কবে তব হৃদয়ের নদী বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি! সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন! পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন! কারাগার-মর্মরের তলে নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ! অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস! -সহস্রের অঙুলিতর্জন নিত্য সহিতেছি মোরা-বারিধির বিপ্লব-গর্জন বরিয়া লয়েছ তুমি, তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো; তোমার পক্ষরতলে টগ্‌বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!- তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার, অবগুণ্ঠিতার হিমকৃষ্ণ অঙুলির কঙ্কাল-পরশ পরিহরি গেলে তুমি-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা চকিতে চূর্ণিয়া গেলে-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট, তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি! নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি! প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি! ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,- অগাধের সাধ তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ! মণিময় তোরণের তীরে মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে হে দুরন্ত দুর্নিবার-প্রাণ তব কাঁদে! ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন, সমুদ্রের যৌবন-গর্জন তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের! টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের হে জলধি পাখি! পে তব নাচিতেছে ল্যহারা দামিনী-বৈশাখী! ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রতœচূড় ময়ূখের টিপ, কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে! বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে! কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে- স্তম্ভিত নয়নে নীল বাতায়নে তাকায়েছ তুমি! অতি দূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী! সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া হে জল-বেদিয়া! অল্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন সিন্ধু বেদুঈন! নাহি গৃহ, নাহি পান্থশালা- লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্যপাতালে- বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে! প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর! সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছুডাকা স্বর ভুলেছ নোঙর! কোন্ দূর কুহকের কূল লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল কে বা তাহা জানে! অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!

নীলিমা

রৌদ্র ঝিল্‌মিল, উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে! -উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী, উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি, আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা, মরীচিকা-ঢাকা! অগণন যাত্রিকের প্রাণ খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান; চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল- হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী। জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী! স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা! চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা! বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত, ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ, লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে, -শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে; ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক, তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

সাগর বলাকা

ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দুরাশায় মেলে! ফেনার বৌয়ের নোন্‌তা মৌয়ের মদের গেলাস লুটে, ভোর-সাগরের শরাবখানায়–মুসল্লাতে জুটে হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!
ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে ছুটছ তুমি চ্ছল চ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই! উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্‌তো ফেনা-সই ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!
রে মুসাফের, পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা সাগরজলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা! তাই কি গেলে ভেঙে হেথায় বালিয়াড়ির বাড়ি! দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু-পাড়ি- ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া, পিছের আকাশ ফিকা!
বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে! ফুটছে ভাষা কেউটে ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে! প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে বরুণরানি ফিরছে যেথা, মুক্তপ্রদীপ জ্বলে যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠে ফুঁকে।
যেই খানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে সাঁজ সকালে, ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে! যায় না জাহাজ যেথায়- নাবিক, পায় না নাগাল যার, লুঘ উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার ঘুরছে অবুজ সে কোন সবুজ স্বপন-খোজার কাজে!
ওরে কিশোর, দূর-সোহাগী ঘর- বিরাগী সুখ! টুকটুকে কোন্‌ মেঘের পারে ফুটেফুটে কার মুখ ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার! -শাদা শকুনপাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন-ফাঁপর ফাটা বুক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...