সংগৃহীত |
সেন্টমার্টিন্স এর গভীর নীল পানি, কিংবা জাফলং এর স্বচ্ছ পানির গল্প তো অনেকই শুনেছি, কিন্তু সবুজ নীলের মিশেলে অদ্ভূত-রঙা হ্রদটার গল্প কি শুনেছেন? না শুনলে আমার লম্বা প্যাচাল শোনার আগে একনজর দেখে নিন।
নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর বিরিশিরিতে এর অবস্থান। যারা সমাজ পরীক্ষা দিতে দিতে বাংলাদেশের মানচিত্র মুখস্থ-ঠোঁটস্থ করে ফেলেছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন নেত্রকোণা বাংলাদেশের কোন কোণাতে অবস্থিত! যাদের এখনো মানচিত্র মুখস্থ হয়নি, তারা ঝটপট দেখে ফেলুন একবার। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ক'দিন আগেই ঘুরে এলাম সেই কোণার জেলা নেত্রকোণার এক কোণায় অবস্থিত দুর্গাপুরের বিরিশিরি।
শুরুতেই বলে নিই কি করে যেতে হবে বিরিশিরি। ঢাকার মহাখালী থেকে বিরিশিরি কিংবা দুর্গাপুরের বাসে উঠতে হবে। বাস ভাড়া খুব বেশি না, দুই-তিনশত টাকা। বাসের যাত্রাটা নেত্রকোণার পর থেকেই খুব বাজে। কারণ জানতে চান? একটু কষ্ট করে নিচের ছবিটায় চোখ বুলিয়ে নিন।
আমাদের মহান জনপ্রতিনিধিদের কাজ-কারবারের নমুনা ...
বুঝতেই পারছেন...এ অসমাপ্ত সেতুর কারণেই ওপারে দুর্গাপুরে সড়ক ব্যবস্থায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সেই দশ কি বারো বছর আগে একবার রাস্তা তৈরি করে দিয়েই হাত গুটিয়ে নিয়েছে সরকার। রাস্তার বর্তমান যে হাল...কোমর ব্যাথা থাকলে ভুলেও ঐদিক যাবেন না, আর ব্যাথা না থাকলে ব্যাথা কোমরে নিয়ে ফিরে আসার জন্য অবশ্যই একবার ঘুরে আসবেন আমাদের মতো।
বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ডই বাসের শেষ গন্তব্য। ঢাকা থেকে সময় প্রায় চার ঘন্টা লাগে। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ওয়াইএমসিএ হোস্টেলে যোগাযোগ করতে পারেন, যদি রাত কাটাতে চান। হাতে একদিন সময় নিয়ে গেলে প্রথম দিন দুর্গাপুর পৌঁছে আমাদের মতো ঘুরে আসতে পারেন বিজয়পুরের সীমান্তেও। পাহাড় আর সবুজে ভ্রম হতে পারে...বান্দরবান কিংবা রাঙ্গামাটি নয়তো?
পাহাড়ে সবুজ
দূর থেকে ভারতের বিএসএফ ক্যাম্প
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা...চলে গেছে ভারতের দিকে
ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত, যদিও ছবি বলছে ভিন্ন কথা ...
পাহাড় ভ্রমণ শেষে ফিরে আসছি আমরা
তখন নিস্তেজ সূর্যও হেলে পড়ছিল ধীরে ধীরে
দুর্গাপুরে সরকারি একটা ডাকবাংলো আছে। যাদের সরকারি ডাকবাংলোতে থাকার সুবিধা আছে, তারা এখানেও থাকতে পারেন। ওয়াইএমসিএ হোস্টেল অপেক্ষা এ ডাকবাংলো বিরিশিরির নিকটবর্তী। ডাকবাংলোর লাগোয়া টেরেসে আবারও আরেক নাম না জানা ফুল! বারবার নাম-না-জানা ফুল বলছি বলে ভাববেন না এ ফুলগুলো খুব দুর্লভ কিসিমের। আসলে আমার ফুলের সম্পর্কে ধারণা শূন্যের সামান্য নিচে।
নাম না জানা ফুল
ফুলের কথা বলতে বলতে মনে পড়লো, পাহাড় থেকে ফেরার পথে গারোদের এক ঘরের সামনে থেকে তোলা আরেকখানা নাম না জানা ফুল! এটা কি পাতাবাহার?
নাম না জানা লাল ফুল
পাহাড় বাইছে গারো শিশু
আদিবাসীদের ব্যাপারে আমার একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ, তারা উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা এই সেটেলার আমাদের বেশ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি শিশুরাও এর বাইরে নয়। ক্যামেরা দেখলেই তাদের নিষ্পাপ মুখে এক ভয়ার্ত ভাব দেখা যায়। এর পেছনেও হয়তো কোনো কারণ আছে। ক্যামেরার পেছনে থাকা মানুষের জন্য এ পরিস্থিতি বেশ অস্বস্তিকর। উল্লেখ্য, উপরের গারো শিশুর ছবিটা আমার বন্ধুর তোলা।
এবার বিরিশিরির যে মূল আকর্ষণ... নীলচে সবুজ হ্রদ, সেখানে যাবার গল্পে আসি। বাসস্ট্যান্ড থেকে ২০০-৩০০ টাকাতে রিকশা ভাড়া করে চলে যেতে পারেন চীনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে জেগে উঠেছে এই নীলচে সবুজ পানির হ্রদ। রিকশাওয়ালাই আপনার গাইড হিসাবে কাজ করবে। মোটর সাইকেলে করেও যেতে পারেন, তাতে সময় কম লাগবে, পয়সা বেশি লাগবে, তবে বেশিক্ষণ ঘুরতে পারবেন না। আর এইসব অভিযানে আমার কেন যেন একটু ধীরে চলতে বেশি ভাল লাগে। সূক্ষ্ণ ডিটেইল নজরে পড়ে বেশি।
যেতে পথে পড়বে সেন্ট যোসেফের গীর্জা। গীর্জাটা বেশ সাজানো গোছানো, নীরব আর খুব সুন্দর।
সেন্ট যোসেফের গীর্জা
ক্রুশবিদ্ধ যীশু
গীর্জার বিভিন্ন জায়গায় অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের চারা লাগানো। তা থেকেই কয়েক স্ন্যাপ!
নাম-জানি-না ফুল
সাদা গোলাপ
গীর্জার কথা বলতে বলতে আবারো অন্য প্রসঙ্গে একটু বলি। বাংলাদেশের বাইরে পা ফেলিনি বলে জানি না অন্য কোন দেশে কোন ধর্মের কি অবস্থা। কিন্তু রাঙ্গামাটি, দুর্গাপুর সহ বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সবখানেই দেখেছি গীর্জার অবস্থান। এটা স্বীকার করতেই হবে আদিবাসীরা বছরের পর বছর ধরে উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা এই আমাদের শোষণের শিকার। কিন্তু সেসব জায়গাতেই গীর্জার আনাগোনা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, শোষিতদেরই কি ধর্মের ছায়াতলে আনা সহজ? নাকি এটাও কোন পলিসি? তাই না দেখেও বুঝতে পারি এবং এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত, এখনকার বৌদ্ধ, মুসলমান আর খ্রিস্টানদের প্রায় সবারই পূর্বপুরুষ নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিল।
যাক গে, ধর্ম প্রসংগ বাদ দিই। ভ্রমণের কথা বলি। অনেকটা দূর গ্রাম্য পথ পাড়ি দিয়ে রিকশা এসে পৌঁছাবে নদীর চরে।
বালুচর
চরে কিছুদূর আপনাকেও ঠেলতে হবে রিকশা। নমুনা নিজ চোখে দেখুন!
রিকশা ঠেলছিল বন্ধু
অবশ্য আমার মত ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরলে এ যাত্রা বেঁচে গেলেও যেতে পারেন ;)
জীবিকার খোঁজে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে...
কবিগুরুর কবিতা মেনে এ নদী চলেনি। শীতে এ নদীতে হাঁটু পানি। চাইলে হেঁটেই পার হতে পারেন। না চাইলে রিকশার সাথে নৌকায় আপনিও সওয়ার হয়ে যান! নদীটা অনেকটাই জাফলং এর নদীর মতো। স্বচ্ছ পানি, তলদেশ স্পষ্ট। পার্থক্য শুধু জাফলং এর পাথর, আর কিছু না।
নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে শুরু হবে আরো দীর্ঘ রিকশা ভ্রমণ। মাঝেই মাঝেই কালভার্ট আর ব্রীজ, রিকশা থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে আবার রিকশা...এমনি করে চলতে হবে অনেকটা পথ।
পথের ধারে এ ফুলগুলো বেশ দেখা যায়। শুধু এই ফুলের অনেক অনেক ছবি তুলেছি আমি , বলা যায় আমার প্রিয় ফুল। এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল নাম কি, নির্মলেন্দু গূণের কাছ থেকে ধার করে বলেছিলাম,
"আমার প্রিয় দুই ফুল
জুঁই ফুল আর তুই ফুল"
তুই ফুল
নিচের ছবিটা পরিবেশ রক্ষার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে আশা করি!
কাঠের গুড়ি
নেত্রকোণায় কাঠ পাচারের এক মজার উপায় শুনলাম। ভারতের পাহাড় থেকে গাছ কেটে কাঠের গুড়ি পাহাড় থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। ঢাল বেয়ে সে গুড়ি এসে বাংলাদেশে পড়ে। রাতে চোরাকারবারীরা এসে কাঠ নিয়ে যায়।
যাই হোক, রিকশায় চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বুঝবেন এসে পড়েছেন হ্রদের কাছে। আমাদের পাহাড় ডিঙ্গোনোর শখ দেখে রিকশাওয়ালারা আমাদের নামিয়ে দিলেন এক পাহাড় আগেই।
এ পাহাড়ের ওপারেই হ্রদ
বলে রাখি, এ পাহাড়ও চীনামাটির পাহাড়। এই পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় দূরের ঐ হ্রদ, যার জন্য শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসেছিলাম নেত্রকোণা।
দূরে দেখা যায় নীলচে-সবুজ হ্রদ
এবার কিছুক্ষণের জন্য বকবক থামালাম। শুধুই হ্রদের ছবি...এখানে কবি(!) নীরব...
হ্রদের জলে পাহাড়ের ছায়া
হ্রদ
হ্রদের গা ঘেঁষে আবারও নাম-না-জানা কোন ফুল
হ্রদের ওপারে আমাদের অভিযাত্রী দল
হ্রদটা কৃত্তিম মনে হয়েছে আমার কাছে। খুব সম্ভবত চীনেমাটির পাহাড়ের বুকে খনন করে বানানো। সেই কারণেই কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পানির রং এরকম হয়ে গিয়েছে হয়তো। রংটা কিছুটা কপার সালফেটের মতো , পানিতে কিছু পরিমাণ কপার সালফেট মেশানো ছিল বলে আমরা ধারণা করেছিলাম।
আমার হাতে চীনেমাটি
সিরামিকের পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয় যে চীনামাটি, তার যোগান দিতে দিতে এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবু চীনেমাটি উত্তোলন থামছে না।
চীনামাটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মজুরেরা
ফিরে যাচ্ছি আমরা...
ফিরে আসার পথে এলোমেলো শাটার টিপে গেলাম। কিছু স্ন্যাপ মনে হলো দেয়ার মতো। দিয়ে দিলাম নিচে।
জীবন যেখানে কঠিন
ডিএসএলআর এর দুঃখ ভোলার অপচেষ্টা ! !
শেষে এসে অনেক কথাই বলার ইচ্ছে ছিল। পাহাড় কেটে সিরামিকের যোগান দিতে চীনেমাটির অবাধ উত্তোলন, ফলে পাহাড়ের বিলীন হয়ে যাওয়া...হ্রদের পানিতে স্থানীয়দের যথেচ্ছাচার...কিংবা পাহাড়ের গায়ে উজবুক অর্ধশিক্ষিতদের হস্তলিপি আর স্বাক্ষর কার্যক্রম... অনেক কিছু নিয়েই অনেক কিছু বলা যেত। তবে আজকাল এসবই ক্লিশে মনে হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানে অস্ট্রিচ এলগরিদ্ম বা উটপাখি এলগরিদম নামে একটা একগরিদম আছে। উটপাখির নামে এলগরিদমের নামকরণের কারণ হলো, মরু ঝড়ে যখন বাতাস আর বালুর তোপে সব উড়ে যায়, উটপাখি তখন বালুতে মাথা ডুবিয়ে পড়ে থাকে। সহজ ভাষায় এলগরিদমটা এরকম---যখন এমন কোনো সমস্যা আসবে যা সমাধান করা যাবে না...তখন এমন ভাব করো যেন সমস্যাটা চোখেই পড়েনি।
কিছুই হয়নি, কিছুই হবে না...চলুন ঘুরে আসি বিরিশিরি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন