মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি
- নির্মলেন্দু গুণ---চাষাভুষার কাব্য
গতকাল ছিল কালো-লালে মেশা
একটি অদ্ভুত টুনটুনি ।
লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে,
পাতার আড়ালে, ফুল থেকে ফুলে ।
তার সোনামুখী ঠোঁট, যেন
কলমের ডগায় বসানো একরত্তি হীরে ।
প্রতিটি আঁচড়ে কেটে ভাগ করছিল
ফুল থেকে মধু, মধু থেকে ফুল;
আমার সমস্ত কলতল ভেসে যাচ্ছিল
আজ সকাল থেকেই রক্তকরবীর ডালে
ফুলের আগুন-জ্বলা হাত;
ফুল তুলছেন এক বৃদ্ধা পূজারিণী ।
তার হাতে রক্তকরবীর নকশা কাটা সাজি ।
মধু নয়, শূন্য বৃন্তে শুভ্রকষধারা ।
কলতলে রক্তকরবীর হু হু কান্না,
আমি কী করব? আমি কী করব?
রক্তকরবীর ডালে আমি তো ফুটিনি ।
আমি পৃথিবীর দুঃখী ফুল,
মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি ।
এবারই প্রথম তুমি
- নির্মলেন্দু গুণ---অচল পদাবলী
ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে
মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না
ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে
ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না৷
ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না
নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি এখানে ছিলে না
এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না
নীল নবঘন গগনে ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
সেই প্রজাপতি
- নির্মলেন্দু গুণ---আনন্দ কুসুম
ফুলের মতো দেয়ালটাতে
একটি প্রজাপতি,
দুঃসাহসে বসলো এসে
আলোর মুখোমুখি;
চিত্রিত নয় কালো রঙের
পাখনা দু'টি মেলে ।
এবার বুঝি এলে ?
দেয়াল জুড়ে লাগল তার
ঘরে ফেরার কাঁপন,
প্রাণের মাছে ফিরল বুঝি
চিরকালের আপন ।
ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে
মৃত্যুখানি কেনা,
শেষ করেছি প্রথম দিনে
হয়নি শুধু চেনা!
চোখের পাশে দেয়ালটিতে
বসলে তুমি যেই,
হঠাৎ-চেনা পাখার রেণু
আঙ্গুল ভরে নেই ।
এমন করে পরের ঘরে
দেয়ালে কেউ বসে?
হঠাৎ যদি ভালোবাসার
পলেস্তার খসে?
আলিঙ্গনে বন্দী করে
প্রতীক বাহুপাশে,
হঠাৎ যদি এই আমাকে
অন্যে ভালোবাসে?
রুপান্তরে পুড়িবে তোর
ক্লান্ত দু'টি ডানা,
চিত্রিত নয় কালো রঙের
পৃথিবী একটানা ।
আমি কেবল আমি কেবল
আমি কেবল দেখি,
ভালোবাসার দেয়াল জুড়ে
একটি প্রজাপতি ।
উপেক্ষা
- নির্মলেন্দু গুণ---দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী
অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷
আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?
মানুষ
- নির্মলেন্দু গুণ---প্রেমাংশুর রক্ত চাই
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।
আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।
মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।
মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।
তুলনামূলক হাত
- নির্মলেন্দু গুণ---না প্রেমিক না বিপ্লবী
তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷
তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই
খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;
আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর
চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,
তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷
তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে
খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,
সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷
তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন
তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷
আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো
তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,
ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷
তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে
আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি
তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো
আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই
হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷
প্রশ্নাবলী
- নির্মলেন্দু গুণ---কবিতা, অমীমাংসিত রমনী
কী ক'রে এমন তীক্ষ্ণ বানালে আখিঁ,
কী ক'রে এমন সাজালে সুতনু শিখা?
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।
সোনার কাঁকন যখন যেখানে রাখো,
সেখানে শিহরে, ঝংকার ওঠে সুরে ।
সুঠাম সবুজ মরাল বাঁশের গ্রীবা
কঠিন হাতের কোমল পরশে জাগে,
চুম্বন ছাড়া কখনো বাঁচে না সে যে ।
পুরুষ চোখের আড়ালে পালাবে যদি,
কী লাভ তাহলে উর্বশী হয়ে সেজে?
বৈধ প্রেমের বাঁধন বোঝো না যদি,
কী ক'রে এমন শিথিল কবরী বাঁধো?
চতুর চোখের কামনা মিশায়ে চুলে
রক্তপলার পাথর-বাঁধানো হার
ছিঁড়ে ফেলে দাও, স্বপ্নে জড়াও ভুলে ।
কী ক'রে এমন কামনা-বাসনা-হারা
তাড়িত সাপের ত্বরিৎ-ফণার মতো
আপন গোপন গহনে মিলাও ধীরে?
বিজলি-উজ্জ্বল তিমির-বিনাশী শিখা
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন