সুকুমার রায় |
রাজার সভায় মোটা মোটা মাইনেওয়ালা অনেকগুলি কর্মচারী। তাদের মধ্যে সকলেই যে খুব কাজের লোক, তা নয়। দ’চারজন খেটেখুটে কাজ করে আর বাকি সবাই বসে বসে মাইনে খায়।
যারা ফাঁকি দিয়ে রোজগার করে, তাদের মধ্যে একজন আছেন, তিনি অসিলক্ষণ পণ্ডিত। তিনি রাজার কাছে এসে বললেন, তিনি অসিলক্ষণ (আর্থাৎ তলোয়ারের দোষ-গুণ) বিচার করতে জানেন। অমনি রাজা বললেন, “উত্তম কথা, আপনি আমার সভায় থাকুন, আমার রাজ্যের যত তলোয়ার আপনি তার লক্ষণ বিচার করবেন।”
সেই অবধি ব্রাহ্মণ রাজার সভায় ভর্তি হয়েছেন, মোটারকম মাইনে পাচ্ছেন, আর প্রতিদিন তলোয়ার পরীক্ষা করছেন, আর বলছেন, “এই তলোয়ারটা ভালো, এই তলোয়ারটা খারাপ।” ভারই কঠিন কাজ! কত তলোয়ার ঘেঁটে-ঘুঁটে, দেখে আর শুঁকে, চটপট তার বিচার করেন।
তাঁর বিচারের নিয়মটি কিন্তু ভারি সহজ! তলোয়ার এনে যখন তাঁর হাতে দেওয়া হয়, তখন তিনি সেটাকে শুঁকে দেখেন। তলোয়ার যারা বানায়, তারা তলোয়ারের গায়ে তাদের মার্কা এঁকে দেয়। তাই দেখে বোঝা যায় কোনটা কার তলোয়ার। পণ্ডিতমহাশয় শুঁকবার সময় সেই মার্কাটুকু দেখে নেন। যাদের উপর তিনি খুব খুশি থাকেন, যারা তাঁকে পয়সা-টয়সা দেয়, আর খাইয়ে-দাইয়ে তোয়াজ করে, তাদের তলোয়ার দেখলেই তিনি নেড়েচেড়ে টিপেটুপে বলেন, “খাসা তলোয়ার! দিব্যি তলোয়ার! হাজার টাকা দামের তলোয়ার!” আর যাদের উপর তিনি চটা, যারা তাঁকে ঘুষও দেয় না, খাতিরও করে না, তাদের তলোয়ার যত ভালোই হোক না কেন, তাঁর কাছে পার পাবার যো নেই। সেগুলি জাতে পড়লেই তিনি অমনি একটু শুঁকেই নাক সিঁটকিয়ে বলে ওঠেন, “অতি বিচ্ছিরি! অতি বিচ্ছিরি! তলোয়ার তো নয়, যেন কাস্তে গড়েছে!”
এমনি ক’রে কত ভালো ভালো কারিকর, কত চমৎকার তলোয়ার বানিয়ে আনে, কিন্তু বিচারের গুণে তার দু-টাকাও দাম হয় না। এর মধ্যে একজন ওস্তাদ কারিকর আছে, সে বেচারা মনপ্রাণ দিয়ে একখানি তলোয়ার গড়ে, আর বিচারক মশাই, “দূর! দূর!” ক’রে সব বাতিল করে দেন। এই রকম হতে হতে শেষটা কারিকর গেল ক্ষেপে।
একদিন সে করল কি, একখানি তলোয়ার বানিয়ে, তার গায়ে বেশ ক’রে লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে অসিলক্ষণ পণ্ডিতের কাছে এনে হাজির করল। পণ্ডিত নিতান্ত তাচ্ছিল্য ক’রে, “আবার কী গরে আনলি?” বলে, যেমনি তাতে নাক ঠেকিয়ে শুঁকতে গেছেন, অমনি লঙ্কার গুঁড়ো নাকে ঢুকতেই হ্যাঁ–চ্ –চো ক’রে এক বিকট হাঁচি, আর সেই সঙ্গে তলোয়ারের আগায় ঘ্যাঁচ ক’রে নাকে কেটে দু’খান!
চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল, “জল আনরে,” “কবিরাজ ডাকরে,”— ততক্ষণে তলোয়ারওয়ালা লম্বা লম্বা পা ফেলে তার বাড়ি পর্যন্ত পিঠ্টান দিয়েছে।
অসিলক্ষণ পণ্ডিতের মহা মুশকিল। একে তো কাটা নাকের যন্ত্রণা, তার উপর সভায় বেরুলে সবাই ক্ষ্যাপায়, “নাক-কাটা পণ্ডিত” ব’লে। বেচারার এখন মুখ দেখানই দায়, সে সভায়ও যেতে পারে না, চাকরিও করতে পারে না। তাকে দেখলেই লোক জিজ্ঞাসা করে, “তঁ লোঁ য়াঁ র টাঁ কেঁমন ছিঁলঁ !”
রাজার সভায় মোটা মোটা মাইনেওয়ালা অনেকগুলি কর্মচারী। তাদের মধ্যে সকলেই যে খুব কাজের লোক, তা নয়। দ’চারজন খেটেখুটে কাজ করে আর বাকি সবাই বসে বসে মাইনে খায়।
যারা ফাঁকি দিয়ে রোজগার করে, তাদের মধ্যে একজন আছেন, তিনি অসিলক্ষণ পণ্ডিত। তিনি রাজার কাছে এসে বললেন, তিনি অসিলক্ষণ (আর্থাৎ তলোয়ারের দোষ-গুণ) বিচার করতে জানেন। অমনি রাজা বললেন, “উত্তম কথা, আপনি আমার সভায় থাকুন, আমার রাজ্যের যত তলোয়ার আপনি তার লক্ষণ বিচার করবেন।”
সেই অবধি ব্রাহ্মণ রাজার সভায় ভর্তি হয়েছেন, মোটারকম মাইনে পাচ্ছেন, আর প্রতিদিন তলোয়ার পরীক্ষা করছেন, আর বলছেন, “এই তলোয়ারটা ভালো, এই তলোয়ারটা খারাপ।” ভারই কঠিন কাজ! কত তলোয়ার ঘেঁটে-ঘুঁটে, দেখে আর শুঁকে, চটপট তার বিচার করেন।
তাঁর বিচারের নিয়মটি কিন্তু ভারি সহজ! তলোয়ার এনে যখন তাঁর হাতে দেওয়া হয়, তখন তিনি সেটাকে শুঁকে দেখেন। তলোয়ার যারা বানায়, তারা তলোয়ারের গায়ে তাদের মার্কা এঁকে দেয়। তাই দেখে বোঝা যায় কোনটা কার তলোয়ার। পণ্ডিতমহাশয় শুঁকবার সময় সেই মার্কাটুকু দেখে নেন। যাদের উপর তিনি খুব খুশি থাকেন, যারা তাঁকে পয়সা-টয়সা দেয়, আর খাইয়ে-দাইয়ে তোয়াজ করে, তাদের তলোয়ার দেখলেই তিনি নেড়েচেড়ে টিপেটুপে বলেন, “খাসা তলোয়ার! দিব্যি তলোয়ার! হাজার টাকা দামের তলোয়ার!” আর যাদের উপর তিনি চটা, যারা তাঁকে ঘুষও দেয় না, খাতিরও করে না, তাদের তলোয়ার যত ভালোই হোক না কেন, তাঁর কাছে পার পাবার যো নেই। সেগুলি জাতে পড়লেই তিনি অমনি একটু শুঁকেই নাক সিঁটকিয়ে বলে ওঠেন, “অতি বিচ্ছিরি! অতি বিচ্ছিরি! তলোয়ার তো নয়, যেন কাস্তে গড়েছে!”
এমনি ক’রে কত ভালো ভালো কারিকর, কত চমৎকার তলোয়ার বানিয়ে আনে, কিন্তু বিচারের গুণে তার দু-টাকাও দাম হয় না। এর মধ্যে একজন ওস্তাদ কারিকর আছে, সে বেচারা মনপ্রাণ দিয়ে একখানি তলোয়ার গড়ে, আর বিচারক মশাই, “দূর! দূর!” ক’রে সব বাতিল করে দেন। এই রকম হতে হতে শেষটা কারিকর গেল ক্ষেপে।
একদিন সে করল কি, একখানি তলোয়ার বানিয়ে, তার গায়ে বেশ ক’রে লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে অসিলক্ষণ পণ্ডিতের কাছে এনে হাজির করল। পণ্ডিত নিতান্ত তাচ্ছিল্য ক’রে, “আবার কী গরে আনলি?” বলে, যেমনি তাতে নাক ঠেকিয়ে শুঁকতে গেছেন, অমনি লঙ্কার গুঁড়ো নাকে ঢুকতেই হ্যাঁ–চ্ –চো ক’রে এক বিকট হাঁচি, আর সেই সঙ্গে তলোয়ারের আগায় ঘ্যাঁচ ক’রে নাকে কেটে দু’খান!
চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল, “জল আনরে,” “কবিরাজ ডাকরে,”— ততক্ষণে তলোয়ারওয়ালা লম্বা লম্বা পা ফেলে তার বাড়ি পর্যন্ত পিঠ্টান দিয়েছে।
অসিলক্ষণ পণ্ডিতের মহা মুশকিল। একে তো কাটা নাকের যন্ত্রণা, তার উপর সভায় বেরুলে সবাই ক্ষ্যাপায়, “নাক-কাটা পণ্ডিত” ব’লে। বেচারার এখন মুখ দেখানই দায়, সে সভায়ও যেতে পারে না, চাকরিও করতে পারে না। তাকে দেখলেই লোক জিজ্ঞাসা করে, “তঁ লোঁ য়াঁ র টাঁ কেঁমন ছিঁলঁ !”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন