মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

সুমুদ্রবিলাস : কক্সবাজার | ভ্রমণ

ফিরোজ শাহরিয়ার |

ভ্রমণ জিনিসটা একটা দারুণ প্রশান্তি দেয়, মনের চোখ খুলে দেয়, আপনার অনুভূতিগুলিকে চৌকস করে। সেটা যদি হয় সমুদ্রদর্শন তাহলে কথাই নেই। বিশেষ করে যারা কম খরচে ঝামেলাহীনভাবে বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবার নিয়ে নিজ উদ্যোগে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ঘুরে আসতে চান, আমার এই লেখাটা মূলত তাদের জন্যে। অনেকেই দিশেহারা হয়ে যান, আমিও হয়েছি এই পিক সিজনে-কীভাবে যাবো, কোথায় উঠবো, কত খরচ হবে, কী খাবো ইত্যাদি ভেবে। লম্বা একটা শ্বাস নিন, বিস্তৃত একটা হাসি দিন, মনে সাহস নিয়ে পকেটে কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। ঠিক যদি করেই ফেলেন যে যাবেন সমুদ্রবিলাসে, তবে হয়ে যাক! মনের ইচ্ছাটাই আসল।
শুরু করি বাসের টিকেট দিয়ে। ঢাকা থেকে অনেকগুলিই বাস আছে কক্সবাজার যাওয়ার। সবারই প্রাইস রেট কাছাকাছি বা একই। ঢাকা টু কক্সবাজার এসি কোচ ১৬০০-২০০০ আর নন এসি ৮০০ টাকা। আমি যেহেতু এখানে উচ্চাভিলাষী সার্ভিসগুলি বাদ দিচ্ছি, তাই বলবো মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড মানে পাবেন ইউনিক, হানিফ, এস আলম, শ্যামলী, সৌদিয়া, টিআর ট্র্যাভেলস ইত্যাদি। ইউনিকে এসি গাড়ি হয় না, ওদের নন এসিতে চড়েও ভালো লেগেছে; সিজনের সময়ে এসির দরকারও হয়না। ভালো কথা, সিজন (season) বলতে এখানে কী বুঝাই আমরা? নভেম্বর থেকে মার্চ-এর শুরু হচ্ছে পিক সিজন সমুদ্র দেখার জন্য, এই সময়টায় গরম কম থাকে, সমুদ্র উত্তাল থাকে না, ফলস্বরূপ ট্যুরিস্টের আনাগোনা বেশি হয়, তাই গাড়ি বলেন আর হোটেল সবখানেই মানুষের ধর্না বেড়ে যায়। তাই অনেক কিছুই যাওয়ার আগে বুকিং দিয়ে যেতে হয়। ফিরে আসি আসল কথায়। বাসের টিকেট মুখে বুক করা যায় না, কেটে রাখতে হয়, অনেকে বিকাশ করে কেটে ফেলেন, আমি সরাসরিই কাটতে বলব। ফেরার ব্যাপারে পরে লিখছি, ওইটা ঢাকা থেকে বুক করার কিছু নাই।
এবার আসি হোটেল বুকিং প্রসঙ্গে। বুকিং করে যাওয়া ভালো, সিজনের সময় যেহেতু। হুট করে গিয়ে পরে না পেলে অহেতুক কিছু এনার্জি খরচ। অগণিত হোটেল-মোটেল আছে কক্সবাজারে। ফোনেই বুক করে ফেলুন, ফেসবুকে পেজ আছে, টিওবি তো আছেই, খোঁজ নিলেই কন্ট্যাক্ট নম্বর পাওয়া যায়। নাগালের দামের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড হোটেল পাবেন ব্লু-মারিন, কল্লোল, সি ক্রাউন, সুগন্ধা রেস্টহাউজ, হানিমুন রিসোর্ট, কোরাল রীফ, এদের ডাবল রুম সিজনে রাতপ্রতি ২০০০-৩০০০৳। চেক-ইন হয় বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটায়। যদি ব্রেকফাস্ট ফ্রি অর্থাৎ কিনা ইনক্লুড থাকে ভাড়ায়, তবে চেক-ইন করে কুপনটা সংগ্রহ করে নিতে হয় হোটেলের রিসেপশন থেকে। সেন্টমার্টিনেও আছে অনেক হোটেল ও রিসোর্ট। মোটামুটি ভালো হোটেলগুলিতে রুমপ্রতি ও রাতপ্রতি সিজনের সময়ে ৳১৫০০ থেকে ১৫০০+ পড়বে। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ড্রিম নাইট, লাবিবা বিলাস, প্রাসাদ প্যারাডাইস, নীল দিগন্ত ইত্যাদি। এইসব হোটেলে রান্নার ব্যবস্থা আছে, আপনি রাজি থাকলে অনেকে হোটেলেই থাকার ভাড়ার সাথে খাওয়ার জন্য কিছু বাড়তি চার্জ নিয়ে আপনাকে তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে, খাবার কী খাবেন তার উপরে চার্জ নির্ভর করবে। ঝামেলা এড়াতে যাওয়ার আগে বুকিং-এর সময়ই আগাম কথা মিটিয়ে নেবেন রেন্টের ব্যাপারে।
এর পরের ধাপ হচ্ছে ঢাকা থেকেই সেন্টমার্টিনের শিপের টিকেট বুক করা। শিপের টিকেট বুক করবেন কেন? যদি ঘাটে গিয়ে তৎক্ষণাৎ কাটেন, রাশ হয়ে যায়, ভালো জায়গা পাওয়া কঠিন হয়। শিপের যাত্রার অভিজ্ঞতা ডেকের পেছনে বাথরুমের সামনে পাওয়া সিটে বসে হলে আপনিই কষ্ট পাবেন। কেয়ারি সিন্দাবাদ, কুতুবদিয়া আছে, গ্রিনলাইন ইত্যাদি রয়েছে। ভাড়া নরমাল ডেকে ৫৫০-৬০০৳ মাথাপিছু যাওয়া-আসা সহ। আমার অভিজ্ঞতা যেমন বলে কেয়ারি সিন্দাবাদে বুকিং না দিয়ে গেলে সিজনে আপনি কোনো টিকেটই পাবেন না। কেউ যদি শিপে না গিয়ে ট্রলারে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে চান, তাহলে বুকিং দরকার হয় না।
এখন আসি, কক্সবাজার ঘুরে দেখা ও থাকা প্রসঙ্গে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছতে লাগবে দশ থেকে বারো ঘন্টা। আপনাকে লিংক রোড বা বাস টার্মিনালে নামিয়ে দিলে আপনি অটোতে করে বীচ পয়েন্টে চলে আসতে পারবেন। অটোর ভাড়া দামাদামি করে নেবেন সবসময়, ট্যুরিস্ট ভেবে যা বলছে তাতেই উঠে যাবেন না। এক অটোতে চার-ছয়জন উঠা যায়। আগেই বলেছি হোটেলে চেক-ইন টাইম সাড়ে এগারটা থেকে বারোটা। কক্সবাজারে সাধ্যের মধ্যে বাঙালি খাবারের জন্য অনেক হোটেলই আছে। পউশিতে চারজনে একবেলা ৫৩০ টাকায় ভরপেট বেশ স্বাদ করে খেয়েছিলাম। আমরা খেয়েছিলাম লইট্যা ফ্রাই, শুঁটকি ভর্তা, ডাল, ভাত, চিকেন বিরিয়ানি, আর আচার সাথেই দেয় যেগুলি অসাধারণ মজা। এছাড়া ঝাউবন আছে, হান্ডি ও কেএফসি আছে, মারমেইড ক্যাফে আছে। ওখানে লোকাল হোটেলগুলিতে রূপচাঁদা ফ্রাই খেতে চাইলে ৩৫০-৪০০৳ পড়বে, তবে দুইজনে মিলে খেতে পারবেন। এরপরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রয়েছে ইনানী ও হিমছড়ি। একদিনে গিয়ে ফিরতে পারবেন। ইনানী সৈকতে না গেলে মিস। অটো রিজার্ভ করে ইনানী-হিমছড়ি যাবেন, একবারে ইনানী হয়ে হিমছড়ি পর্যন্ত যাওয়া ও আসা মিলিয়ে ৬০০-৭০০৳ পড়বে, দামাদামির উপরে নির্ভর। এছাড়া কেউ মিস করতে চায় না যেটা সেটা হলো অরিজিনাল বার্মিজ মার্কেট। কক্সবাজার শহরে এখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মত অনেক বার্মিজ মার্কেট গজিয়েছে তবে রিকশাওয়ালা বা অটোওয়ালাদের বললে তারা আসলটায় নিয়ে যাবে। দেখার মত আরও আছে ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, রামু মন্দির ইত্যাদি, তবে সেইগুলি একটু দূরে হওয়ায় সেভাবে বাজেটও বাড়বে, আমি সেইগুলির বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না।
এরই ফাঁকে আপনি বাস কাউন্টারগুলিতে খোঁজ নিয়ে নিতে পারেন ঢাকায় ফেরার টিকেটের জন্য, কেটেও ফেলতে পারেন আগাম, যদি নিশ্চিত থাকেন ফেরার তারিখের ব্যাপারে। বাস কাউন্টারগুলি ক্লাস্টারের মত, সব একটা আরেকটার কাছাকাছিই অবস্থিত, হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে বা রিকশা নিয়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন। আর যদি টেকনাফ থেকে ঢাকা যাত্রা করেন তো সেটা পরের ব্যাপার।
কক্সবাজার ঘোরা শেষে প্ল্যান মোতাবেক এবার সেন্টমার্টিন যাওয়ার পালা। এজন্যে প্রথমেই সকালবেলা মানে ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যেই অটো নিয়ে পৌঁছতে হবে লিংক রোডে। ওখান থেকে মাইক্রো পাবেন, বাসও পাবেন, মাইক্রো ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ করে, বাস ভাড়া ১৪০ করে, সরাসরি বাস সার্ভিস নামে বাস আছে ছোট বাস (কোচ টাইপ না)। সদস্য বেশি হলে ফুল মাইক্রো রিজার্ভ করেও নিতে পারেন চাইলে। রাস্তা খারাপ এইটা মাথায় রেখেই বাসে উঠতে হবে। সকাল ৯টার মধ্যে টেকনাফ দমদমিয়া ঘাটে পৌঁছে যাবেন। শিপ ছাড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে নয়টায়। এখানে বলে রাখি, জাহাজ সাড়ে নয়টায় ছাড়লেও আগে যাওয়া ভালো, ভালো জায়গায় বসতে পারবেন দেখেশুনে, নাহলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে পুরোটা সময় সেটা তার ব্যাপার। যে টিকেটে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন যাবেন, সে টিকিটেই আসতে হবে, যদিও অনেক সময়ই টিকেট চেক করে না, তবে সাথে টিকেটটা না ফেরা পর্যন্ত রাখবেন, হারাবেন না। যাওয়ার সময় প্রথমে নাফ নদীর স্রোত কম, আস্তে আস্তে সাগরে ঢুকলেই ঢেউ বাড়তে থাকে, বমির ট্যাবলেট খেয়ে নিতে পারেন, অনেকেই সি-সিকনেসের প্রেশারে পড়েন। ওয়াটার-ফোবিক হলে দুলতে থাকা পানির ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকুন, গল্প করে বা অন্যদিকে মনোযোগ দিয়ে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করুন। সিগাল পাখিগুলি অসম্ভব সুন্দর, এদের খাওয়াতে চান ভালো কথা, তবে নিজেরা নদী/সাগরের পানিতে চিপস/বিস্কুটের প্যাকেট কিংবা পানির বোতল ফেলে নিজেকে তিন নম্বর ছাগশিশু হিসেবে প্রমাণ করবেন না।

সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ ফেরার সময়ে একই সিস্টেম। শিপে যে টিকেটে গিয়েছিলেন, যদি যাওয়া-আসা সহ নেন, সেই টিকেটেই ফেরা। অতএব ফিরতি পথে জাহাজ ও ডেক বদলের সুযোগ নেই। শিপ ছাড়ে দুপুর আড়াইটায়, আর টেকনাফ ঘাটে এসে ভিড়ে সাড়ে ৫টা-৬টা নাগাদ। আর ট্রলার হলে রিজার্ভ করতে পারেন, আবার এমনিও একটায় উঠে যেতে পারেন। অফ-সিজনে সমুদ্র উত্তাল থাকে বলে শিপ চলে না, তখন ট্রলারই (ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা) ভরসা। আর সিজনেও ট্রলারে ভয়াবহ দুলুনি আর ঢেউয়ের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবে। সাথে শিশু ও বয়স্ক মানুষ থাকলে ট্রলার নেবেন না। ঘাটের কাছে বাস পাওয়া যায়। মিনিবাসে করে কক্সবাজারে যেতে পারেন, কক্সবাজার সিটিতে পৌছাতে আড়াই-তিন ঘন্টা লাগবে। সেখান থেকে ঢাকাগামী বাসে উঠতে পারেন। কেউ যদি কক্সবাজার থাকতেই টিকেট কেটে রাখেন, সিজনের সময়ে সিট পাচ্ছি না জাতীয় বিপদে পড়তে হয় না। আর যদি টেকনাফ থেকেই রওনা হন ঢাকা, সেক্ষেত্রে বাস ভাড়া টেকনাফ টু ঢাকা নন এসি ৳৯০০, এসি ৳১৯০০-২২০০ ও ঊর্ধ্বে।
টেকনাফ থেকে প্রবাল দ্বীপ পৌঁছতে ১২:১৫-১২:৩০ টা বাজবে। নেমে ভ্যানে করে এরপর কিছুটা হেঁটে হোটেলে যেতে হবে। পুরো ভ্রমণের সুবিধার্থে আমি লাগেজ যতটা পারা যায় হালকা রাখতে সাজেস্ট করবো। হোটেলে চেক-ইনের সময় এখানেও একই। দারুচিনি দ্বীপটার সুবিধা হলো এখানে পুরোটাই দেখার মত জায়গা। রিসোর্টগুলিও সত্যি বলতে ছবির মত! কোনো বেলাভূমি পাবেন না, পায়ের কাছে সমুদ্র এখানে। রিসোর্টগুলিতে মিঠাপানির স্বল্পতা ও কারেন্টের প্রব্লেম থাকবে দ্বীপ অঞ্চল বলে। ওখানে গিয়ে সার্বক্ষণিক বিলাসিতা চাওয়াটা বোকামি। পানির রঙ সবচেয়ে নীল আর স্বচ্ছ হয় জোয়ারের সময়! বারবিকিউ করার আলাদা মজা আছে। এখানকার ডাব-নারিকেল খেতে ভুলবেন না, তবে দোকানী বুঝে দামাদামি করে নিয়ে খাবেন, নাহলে বেদম ঠকতে হবে। ছেঁড়াদ্বীপে ঘুরে আসতে পারেন, বোটে করে যেতে হবে, হাঁটার অভ্যাস থাকলে হেঁটে ভাটার সময়ে একেবারে সকালে ঘুরে আসে অনেকে। প্রবালদ্বীপে প্রচুর প্রবাল, প্রবালে পা কাটে অনেক সময়ই, সাবধানে হাঁটবেন। রাতের সমুদ্র অন্যরকম সুন্দর; রাতের কক্সবাজারের মতই রাতের সেন্টমার্টিন এক অন্যরকম মাদকতা তৈরি করে! পুরো দ্বীপটা আমার কাছে ছবিতে দেখা কোনো ক্যারিবীয় দ্বীপের চেয়ে কম সুন্দর মনে হয়নি।
উপভোগ করুন ভ্রমণ। ট্যুরে খুব প্ল্যান করে কিছু হয় না। শুধু একটু মাথা ও চোখ খোলা রাখবেন। আমাদের নিজেদের ট্যুরে টিওবি গ্রুপটা দুর্দান্ত কাজে এসেছে, আমরা চিরকৃতজ্ঞ! যা বুঝেছি, সব মিলিয়ে যদি ধরেন দিন তিন-চারেকের ট্যুর হয়, তাহলে মাথাপিছু সাড়ে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা নিলে আপনার ভালোভাবেই ট্যুর সারা হবে যদি না আপনি অতি খরচে পাবলিক হন। পুরো ভ্রমণে নিজেদের প্রতি ও প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা অব্যাহত রাখুন। সব মিলিয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর সৌন্দর্য আমরা সবাই মিলে অটুট রাখি।
সেন্টমার্টিনের অসাধারন ভিড়িওটি দেখে নিন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...