শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বাগর্থ | বাংলা ব্যাকরণ

অর্থ পরিবর্তন

বাগর্থ (বাক+অর্থ) একটি সন্ধিজাত শব্দ। বাক বা শব্দের অর্থই বাগর্থ। একটি শব্দে আভিধানিক অর্থ থাকলেও সেই অর্থের বাইরেও নানা অর্থ প্রকাশ পেতে পারে। যদি কেউ বলে, চলার সময় চোখ কান খোলা রেখো। এখানে শরীরের সাথে যে ‘চোখ বা কান’ থাকে তার কথা না বলে সজাগ বা সচেতন থাকার কথা বলা হয়েছে। বাগর্থ ও শব্দার্থ একে অন্যের পরিপূরক। শব্দের অর্থবিচার, অর্থের বিভিন্ন দিক, তার পরিবর্তন, প্রসার ও সংকোচন ইত্যাদি বিচারের যে বিজ্ঞান তাকেই বাগর্থ বলে। তবে এই অর্থ সাধারণ বা আক্ষরিক অর্থ বুঝিয়ে থাকে। কারণ আক্ষরিক অর্থ প্রকাশিত হলেই অন্যান্য অর্থ প্রকাশিত হবে। যদি কথা শব্দের অর্থ গূঢ় হয় তাহলেও এর আক্ষরিক অর্থ অগ্রাহ্য করার উপায় থাকে না।


ঐতিহাসিক শ্রেণিবিভাগ
বাংলা ভাষায় যেসব শব্দ স্থায়ী আসন নিয়েছে সেসব শব্দ কালক্রমে অর্থও পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণত অর্থকে কেন্দ্র করেই কিন্তু এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বাগর্থ জ্ঞিানীরা তিনটি অর্থপরিবর্তনের কথা বলেছেন। কোন কোন অর্থ নির্দিষ্ট অভিধানে গৃহীত বা আভিধানিক। এসব শব্দকে মুখ্যার্থ আর অন্যদিকে মুখ্যার্থ থেকে জাত আলংকারিক বিশিষ্টার্থক শব্দকে বলা হয় গৌণার্থ। বিশেষ বিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব শব্দ বদলে যায়। তিনটি কারণে, ‘অর্থপ্রসার, অর্থসংকোচন, অর্থবদল বা অর্থসংক্রম হয়’। এছাড়া অর্থালংকার অনুসারেও শব্দের অর্থ পরিবর্তন হতে পারে। যেমন :

১. শব্দের অর্থপ্রসার বা উৎকর্ষ বা উন্নতি
যেসব শব্দের মূল বা পূর্বরূপ ও সম্প্রসারিত রূপ এক নয় তাদের শব্দের অর্থপ্রসার বা উৎকর্ষ বা উন্নতি বলে। রূপক বা অতিশয়োক্তির ফলে কখনো কখনো অর্থের বিস্তৃতি ঘটে। এখানে ক্ষুদ্র অর্থ থেকে অর্থের বিস্তৃতি ঘটে। যেমন :
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সম্প্রসারিত অর্থ
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সম্প্রসারিত রূপ
গুন
গরুর নাড়িভুড়ি বা তাঁত    
দড়ি
ইতিকথা
অর্থশূন্য বাক্য
ইতিহাস
অপরূপ
কদাকার
অপূর্ব সুন্দর
পরশ্ব
আগামিকালের পরদিন
আগামিকালের পরদিন
অদৃষ্ট
অদেখা
ভাগ্য/নিয়তি
মন্দির
গৃহ
দেবতার আলয়
অভিষেক
স্নান
উচ্চপদে আসিন
ধ্যান
চিন্তা
পরমার্থ চিন্তা
দরিয়া
নদী
সমুদ্র
গাঙ
গঙ্গা
যে কোন নদী

২. শব্দের অর্থসংকোচ বা অপকর্ষ বা অবনতি
যেসব শব্দের মূল বা পূর্বরূপ ও সংকোচিত রূপ এক নয় তাদের শব্দের অর্থসংকোচ বা অপকর্ষ বা অবনতি বলে। শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে কোন একটি মুখ্য হয়ে উঠলে অন্যান্য অর্থের বিলুপ্ত ঘটলে অর্থসংকোচ হয়। এখানে বিস্তৃত অর্থ থেকে ক্ষুদ্র অর্থ ঘটে। যেমন :
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সম্প্রসারিত অর্থ
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সংকোচিত রূপ
বুয়া
দাদি, নানি
কাজের মহিলা
কীর্তিকলাপ
নানা সুখ্যাতি
অপকীর্তিসমূহ
মহাজন
মহৎজন
সুদখোর
মুর্গ
যে কোন পাখি
মোরগ
ঝি
কন্যা/মেয়ে
কাজের মেয়ে/দাসী
অন্ন
যে কোন খাদ্য
ভাত
মৃগ
যে কোন পশু
হরিণ
Meat
যে কোন খাদ্য
মাংস
উজবুক
উজবেকের অধিবাসী
নির্বোধ/বোকা/মূর্খ



৩. শব্দের অর্থবদল বা অর্থসংক্রম
যেসব শব্দের মূল বা পূর্বরূপ ও সংক্রমিতরূপ এক নয় তাদের শব্দের অর্থবদল বা অর্থসংক্রম বলে। অর্থের প্রসার ও সংকোচনের ফলে কখনো কখনো কোন কোন শব্দের এমন অর্থ তৈরি হয়ে যায় যখন তাদের সঙ্গে মূল অর্থের সংযোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে তাদের অর্থবদল বা অর্থসংক্রম বলা হয়। যেমন:
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সম্প্রসারিত অর্থ
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সংক্রমিত রূপ
ঘর্ম
গরম
ঘাম
পাষণ্ড
ধর্মসম্প্রদায়
নিষ্ঠুর
পাত্র
পানাধার
বর
অনটন
গতিহীন
অভাব
world
প্রাচীন মানুষ
পৃথিবী
অবকাশ
     ফাঁক
অবসর
শুশ্রূষা
জানার ইচ্ছা
সেবা
অমূলক
মূলহীন
কাল্পনিক

৪. শব্দের অর্থালংকার
যেসব শব্দের মূল বা পূর্বরূপ ও অলংকৃত রূপ এক নয় তাদের শব্দের অর্থালংকার বলে। অর্থালংকার অর্থাৎ উপমা ও রূপক অলংকারের সাহায্যেও অনেক সময় শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়। যেমন:
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
সম্প্রসারিত অর্থ
শব্দ
মূল বা পূর্বরূপ
অলংকৃত রূপ
শ্বাপদ
যার পা কুকুরের মত
শিকারি পশু
গো
গরুর চোখ
জানালা
উদ্বেল
বেলাভূমি
ব্যাকুল
স্তম্ভিত
স্তম্ভাকৃতি
বিস্মিত
দারুণ
কাষ্ঠ নির্মিত
অত্যন্ত
পেট
কলসি/বস্তা
উদর
গোষ্ঠী
যেখানে গরু থাকে
সমষ্টি




ব্যঞ্জনার্থ
শব্দের গূঢ়ার্থ প্রকাশক গুণকেই ব্যঞ্জনার্থ বলে। এখানে শব্দের অর্থ বা বাক্যের ব্যঞ্জনার্থের দ্যোতনা থাকতে পারে। আসলে ব্যঞ্জনার সঙ্গে অভিব্যক্তিই ব্যঞ্জনার্থ। এখানে শব্দের অর্থ মুখ্যার্থ অথবা লক্ষার্থ না ধরে তাকে অতিক্রম করে যে অর্থ তাই ব্যঞ্জনার্থ। অর্থপ্রকাশের দিক দিয়ে ব্যঞ্জনার্থ দুই প্রকার। যেমন:

ক) অভিধা বা সরল ব্যঞ্জনার্থ
যা সরলভাবে বলা হচ্ছে তাই হলে হবে অভিধা বা সরল অর্থ। একটি শব্দের একাধিক অর্থ থেকে অধিক ব্যবহৃত একটি শব্দকে অভিধা বা প্রসিদ্ধ অর্থ বা সরল অর্থ বলে। যেমন: ‘করী’ অর্থ ‘যার হাত আছে বুঝালেও’ ‘হাতি’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। একে ব্যাচার্থও বলে। একে অভিধা শক্তিও বলে। কারণ এখানে যেসব শব্দের অর্থ সাধারণভাবে বুঝা যায় শুধু সেসব শব্দই এপর্যায়ে পরে। যেমন: মানুষ, গরু, ছাগল, গাছ, বই, আকাশ ইত্যাদি। শব্দে ব্যুৎপত্তির ব্যবহারিক অর্থের উপর নির্ভর করে অভিধা বা সরল ব্যঞ্জনার্থ তিন প্রকার। যেমন:

১. যোগশব্দ
ব্যুৎপত্তির ব্যবহারিক অর্থের দিক দিয়ে একই অর্থবোধক শব্দকে যোগশব্দ বলে। ব্যুৎপত্তি অর্থ বিশেষভাবে উৎপত্তি। যেমন:
শব্দ        ব্যুৎপত্তি অর্থ  ব্যবহারিক অর্থ
চালক      যে চালায়    যে চালায়
২. রূঢ়শব্দ
ব্যুৎপত্তির অন্তর্গত অনেকগুলো শব্দ থেকে ব্যবহারিক একটি অর্থপ্রকাশক শব্দকে রূঢ়শব্দ বলে। অথবা যেসব শব্দ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ না বুঝিয়ে বিশেষ কোন অর্থ প্রকাশ করে তাদের রূঢ়শব্দ বলে। অথবা সমস্যমান পদের অনুগামি না হয়ে বিশেষ কোন অর্থ প্রকাশ করে তাদের রূঢ়শব্দ বলে। যেমন:
শব্দ                      ব্যুৎপত্তি অর্থ            ব্যবহারিক অর্থ
পঙ্কজ (যা পঙ্কে বা কাঁদায় জন্মে)   শৈবাল, শালুক, পদ্মফুল          পদ্মফুল
জলধি (যা জল ধারণ করে)      নদী, বিল, পুকুর, সাগর    সাগর
জলদ                    যে জল দেয়            মেঘ
সম্বন্ধী                    যার সঙ্গে সম্বন্ধ আছে        স্ত্রীর বড় ভাই
৩. রূঢ়িশব্দ
যেসব শব্দ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অগ্রাহ্য করে বিশেষ কোন অর্থ প্রকাশ করে তাদের রূঢ়িশব্দ বলে। যেমন:
শব্দ
ব্যুৎপত্তি অর্থ
ব্যবহারিক অর্থ
শব্দ
ব্যুৎপত্তি অর্থ
ব্যবহারিক অর্থ
বাঁশি
বাঁশের তৈরি বস্তু
যে কোন বাদ্যযন্ত্র
তৈল
তিলজাত
যে কোন স্নেহ পদার্থ
শুশ্রূষা
শোনার ইচ্ছা
সেবা
সন্দেশ
খবর
মিষ্টান্ন বিশেষ
মিছরি
মিশরের জিনিস
মিষ্টি দ্রব্য
গবেষণা
গরু খোঁজা
ব্যাপক অধ্যয়ন
চিনি
চীন দেশে তৈরি     মিষ্টি
দ্রব্য
গোধূলি
গরুর পায়ের ধূলি
সন্ধ্যাবেলা
মণ্ডপ
যে মণ্ড পান করে
ছাউনি
সম্ভ্রম
ভয়
সম্মান
পাষণ্ড
ধর্ম সম্প্রদায়
নির্দয় ব্যক্তি
হরিণ
যে হরণ করে
এক জাতীয় পশু
ব্যাঘ্র
যে বিশেষভাবে ঘ্রাণ নেয়
বাঘ
গোষ্ঠী
গরুর পাল
সমষ্টি
হস্তী
যার হস্ত আছে
হাতি
পানজাবি
পানজাবের অধিবাসি
জামা বিশেষ
প্রবীণ
প্রকৃষ্ট বীণা বাদক
প্রবীণ ব্যক্তি
আনাজ
শস্য
কলা বিশেষ

খ) তির্যক ব্যঞ্জনার্থ
সরলভাবে না বুঝিয়ে অন্য অর্থ প্রকাশক শব্দ বা বাক্যকে তির্যক ব্যঞ্জনার্থ বলে। অর্থাৎ কথার উত্তরটা সোজা না হয়ে বাঁকা বা একাধিক বার হয়। যেমন: তুমি খেয়েছ? এখানে বক্তা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর দিতে পারে। আবার এমনও হতে পারে তাকে খাবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। এখানে একের অধিক বুঝ আসতে পারে। একই বাক্যের মাধ্যমে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা প্রকাশ পেতে পারে। অর্থপ্রকাশ বা বাগর্থ প্রকাশ অনেকটাই আক্ষরিক কাজ। সহজ অর্থপ্রকাশ হলো যা বলা বা বোঝানো হচ্ছে মোটামুটি তাই। এটি যদি আক্ষরিকভাবে না বোঝায় তাহলে তির্যক ব্যঞ্জনার্থ হয়।
‘দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দাও’ কখন নির্দোষ অনুরোধ আর কখন অপমানমূলক ঘাড়ধাক্কার বাক্যরূপ তা বোঝাবার জন্য যে যুক্তিবিচার এবং নৈয়ায়িক জিজ্ঞাসা দরকার তা বিদেশি কেনো ভাষার বক্তাও সঙ্গে সঙ্গে বুঝে উঠতে পারেন না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...