মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

কুষ্টিয়া | লালনের শহর

ফিরোজ শাহরিয়ার |

আমাদের উদ্দেশ্য কুষ্টিয়া ভ্রমণ। বিশেষ করে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ এর মাজার। তিনি এই কুষ্টিয়া জেলাতেই জীবন কাটিয়েছেন। তার মাজার বর্তমানে বাউলদের আখড়া হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। লালন ভক্তের কাছে তাই অঞ্চলটি পূন্যভূমি রুপে পরিগণিত।

প্রতিবছর ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়া জেলা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়া জেলা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধ। কুষ্টিয়া জেলায় জন্ম গ্রহন করেছেন বাউল সম্রাট লালন, সুরকার ও কবি আজিজুর রহমান, কবি দাদ আলী, লেখিকা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আবু জাফর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান।

ঢাকা থেকে ট্রেনে পোড়াদহ। সেখান থেকে কুষ্টিয়া শহর। এরপর রিক্সাযোগে যাওয়া যায় লালনের মাজারে। সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট।


শিলাইদহের কুঠিবাড়ি

শিলাইদহের কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে আম্রকাননে কবিগুরু অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। কবিপ্রেমীরা এখানে এসে কবি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। কুঠিবাড়িটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কুষ্টিয়া শহরের একপাশে অবস্থিত ঘোড়ার ঘাট পার হয়ে রিক্সা / ভ্যানযোগে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি পৌছানো যায়। ঘোড়ার ঘাটের অন্য পাড় হতে কুঠিবাড়ি পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ৩৫ মিনিট।

মীর মশাররফ হেসেনের বাস্তুভিটা

কুষ্টিয়া শহরের অদূরে লাহিনীপাড়াতে মীর মশাররফ হেসেনের বাস্তুভিটা অবস্থিত। মীর মশাররফ হেসেনের ঘর-বাড়ি কিছুই নেই, আছে শুধু পৈত্রিক ভিটা। কুষ্টিয়া শহর থেকে রিক্সাযোগে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট।

শাহী মসজিদ

মোঘল আমলে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটি এই অঞ্চলের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক।

কুষ্টিয়া শহর থেকে ঝাউদিয়া অভিমুখী মিনিবাস চলাচল করে। মিনিবাস থেকে ঝাউদিয়া বাজারে নেমে পাঁচ-সাত মিনিট পথ হাঁটলেই শাহী মসজিদ। পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ । স্বাধীনতার পর মুক্ত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর। মুক্ত বাংলা ভাষ্কর্যটি এ বিশ্ববিদ্যালয়েই অবস্থিত ।

দেশের প্রায় ১৪০০ ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত ।

কুষ্টিয়া শহর থেকে যশোর / খুলনা অভিমুখী যেকোন বাসে উঠলেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নামা যাবে । পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।

হার্ডিঞ্জ ব্রীজ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রীজ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত। এই সেতুর নির্মানকাল ১৯০৯-১৯১৫। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নামানুষারে এমন নামকরন। এর দৈর্ঘ্য ১৭৯৮.৩২ মিটার বা ৫৯০০ ফুট। এর উপর দুটি ব্রড গেজ রেললাইন রয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সেতুর একটি স্প্যান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানের গোলায় ধ্বংস হয়ে যায়।

ভেড়ামারা বা উত্তরবঙ্গ অভিমুখী বাসে হার্ডিঞ্জ ব্রীজে পৌছানে যায়। পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন শাহ সেতু

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পাশে অবস্থিত।

ভেড়ামারা বা উত্তরবঙ্গ অভিমুখী বাসে হার্ডিঞ্জ ব্রীজে পৌছানে যায়। পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।

মোহিনী মিল

সচল অবস্থায় মোহিনী মিল সমগ্র এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড়ের কলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মিল।

কুষ্টিয়া শহর থেকে রিক্সাযোগে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। কুষ্টিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ত্ব মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস এন্ড কোম্পানী লিমিটেড নামে এই কাপড়ের মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সমসাময়িক কালে অন্যান্য বস্ত্র কলের তুলনায় এই মিলের উৎপাদন অনেক বেশী মানসম্পন্ন ছিল বলে কালক্রমে এটি দেশের অন্যতম সেরা কাপড়ের মিলে পরিণত হয়।

সচল অবস্থায় মোহিনী মিল সমগ্র এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড়ের কলের স্বীকৃতি লাভ করে।

মাত্র ৮টি তাঁত নিয়ে মিলটি উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তীতে মোহিনী মিল ব্যপ্তি লাভ করে। এর শ্রমিক সংখ্যা প্রায় তিন হাজারে উন্নীত হয়। মোহিনী মিলের শাড়ি ও ধুতী বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এই মিলটি মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর সমাজ সেবা ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থাপনার অন্যতম স্মারক। তাঁর মৃত্যুর পর নানাবিধ কারণে মিলটি প্রতি বছর বিপুল পরিমানে লোকসান দিতে থাকে। অবশেষে ১৯৮২ সালে মোহিনী মিল দেউলিয়া তালিকাভুক্ত হয়। এর পর সরকারের নিকট থেকে মেসার্স আফসার গ্রুফ ইন্ড্রাস্ট্রিজ এর মালিক জনাব নজরুল ইসলাম এই মিলটি কিনে নেন এবং ১৯৮৪ সালে ২৫ শে সেপ্টেম্বের থেকে শাহ মাজদুম টেক্সাইল মিলস লিমিটেড নামে নামকরণ হয়। কিছুদিন পর তাও বন্ধ ঘোষনা করা হয়।

বর্তমানে মিলটি পরিত্যক্ত, ধ্বংসপ্রায় ভগ্নস্তুপে পরিণত হতে চলেছে। সামান্য কিছু নষ্ট মেশিন ও পরিত্যক্ত ঝুকিপূর্ণ ভবন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

রেইনউইক বাঁধ

রেইনউইক বাঁধ কুষ্টিয়া শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এটি গড়াই নদীর কবল থেকে শহর রক্ষা বাঁধ। রিক্সাযোগে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১০ মিনিট।

ডবলিউ বি রেনউইক নামে জনৈক স্কটিশ ভদ্রলোক রাজশাহী জেলার বাগাতী পাড়া থানার লক্ষণ হাটি নামক স্থানে ১৮৮১ সালে মেসার্স রেনউইক এন্ড কোম্পানী নামে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাটি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি লিমিটেড কোম্পানীতে রুপান্তরিত হয়। চিনি কলের যাবতীয় খুচরা যন্ত্রাংশ, কৃষিযন্ত্র, আখ মাড়াই কল ও তার যন্ত্রাংশ এই কারখানায় তৈরী করা হয়।

ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার এবং তৈরী যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রেনউইক একই নামে কুষ্টিয়া জেলায় ১৯১৪ সালে আরো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তখন থেকেই কুষ্টিয়ার এই কারকানাকেই তাঁর কোম্পানীর প্রধান অফিস এবং রাজশাহীর লক্ষণহাটি অফিসকে এর শাখা অফিস হিসাবে গন্য করা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণ করা হয় এবং জাহাজ নির্মাণ সংস্থার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে কারখানাটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থাধীনে নেয়া হয়।

এই মিলের উত্তর দিক সংলগ্ন গড়াই নদী। নদীর তীরবর্তী বাঁধ এবং এর সঙ্গেই মিলে পতিত জমিতে লাগনো মনোরম বৃক্ষ শোভিত স্থানটি কুষ্টিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে আসেন। নদীর তীরে এই স্থানটি শহরের মানুষের কাছে অবসর বিনোদনের জন্য জনপ্রিয়।

এই স্থানটির একটি বিশেষত্ব এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুইই দেখা যায়। এই দুই সময়েই এখানে লোক সমাগম বেশি হয়। বর্তমানে বাঁধের পশ্চিমে নদীর বাঁকে বাঁধটি বর্ধিত করা হয়েছে। আরো বেশি সৌন্দর্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। এই বাঁধটি রেনউইক বাঁধ নামে পরিচিত ।

এক কিলোমিটার পূর্বে থানাপাড়াতে ২য় এবং এক কিলোমিটার পশ্চিমে ৩য় বাঁধ রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...