পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দের সংজ্ঞা ও প্রকরণ
সব ভাষায় লিঙ্গভেদে শব্দভেদ আছে, বাংলা ভাষায়ও আছে। বাংলা ভাষায় বহু বিশেষ্য পদ রয়েছে যাদের কোনোটিতে পুরুষ ও কোনোটিতে স্ত্রী বোঝায়। যে শব্দে পুরুষ বোঝায় তাকে পুরুষবাচক শব্দ আর যে শব্দে স্ত্রী বোঝায় তাকে স্ত্রীবাচক শব্দ বলে। যেমন : বাপ-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে কেউই মৃত্যুর সময় তার কাছে ছিল না। এ বাক্যে বাপ, ভাই ও ছেলে পুরুষবাচক শব্দ আর মা, বোন ও মেয়ে স্ত্রীবাচক শব্দ।
বাংলায় পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন :
১. পতি/স্বামী ও পত্নীবাচক অর্থে
আব্বা-আম্মা চাচা-চাচি কাকা-কাকি জ্যাঠা-জেঠি দাদা-দাদি নানা-নানি
নন্দাই-ননদ দেওর-জা ভাই-ভাবি/বৌদি বাবা-মা মামা-মামী
২. পুরুষ ও মেয়ে বা সাধারণ পুরুষ বা স্ত্রীজাতীয় অর্থে
খোকা-খুকি পাগল-পাগলি বামন-বামনি ভেড়া-ভেড়ি মোরগ-মুরগি
বালক-বালিকা দেওর/দেবর-ননদ
নিত্য স্ত্রীবাচক শব্দ
কতগুলো শব্দ নিত্য স্ত্রীবাচক। এগুলোর পুরুষবাচক শব্দ নেই। যেমন : সতীন, সৎমা, এয়ো, দাই, সধবা ইত্যাদি।
কতগুলো শব্দের আগে নর, মন্দা ইত্যাদি পুরুষবাচক শব্দ এবং স্ত্রী, মাদী, মাদা ইত্যাদি স্ত্রীবাচক শব্দ যোগ করে পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন :
নর/ মদ্দা/ হুলো বিড়াল-মেনি বিড়াল মদ্দা হাঁস-মাদী হাঁস মদ্দা ঘোড়া-মাদী ঘোড়া
পুরুষ লোক-মেয়েলোক/স্ত্রীলোক বেটাছেলে-মেয়েছেলে পুরুষ কয়েদি-স্ত্রী/মেয়ে কয়েদি
এঁড়ে বাছুর-বকনা বাছুর বলদ গরু- গাই গরু
কতগুলো পুরুষবাচক শব্দের আগে স্ত্রীবাচক শব্দ প্রয়োগ করে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন :
কবি-মহিলা কবি ডাক্তার-মহিলা ডাক্তার সভ্য-মহিলা সভ্য কর্মী-মহিলা কর্মী
শিল্পী-মহিলা বা নারী শিল্পী সৈন্য-নারী/ মহিলা সৈন্য পুলিশ-মহিলা পুলিশ
কতগুলো শব্দের শেষে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ যোগ করে পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন :
বোন-পো-বোন-ঝি ঠাকুর-পো-ঠাকুর-ঝি ঠাকুর দাদা/টাকুরদা-ঠাকুরমা গয়লা-গয়লা-বউ জেলে-জেলে বউ
অনেক সময় আলাদা আলাদা শব্দে পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক বোঝায়। যেমন :
বাবা-মা ভাই-বোন কর্তা-গিন্নি ছেলে-মেয়ে সাহেব-বিবি জামাই-মেয়ে
বর-কনে দুলহা-দুলাইন/দুলহিন বেয়াই-বেয়াইন তাওই-মাওই বাদশা-বেগম শুক-সারী
বাংলা স্ত্রী প্রত্যয়যোগে শব্দগঠন
বিভিন্নভাবে পুরুষ থেকে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা যেতে পারে। যেমন:
বাংলা স্ত্রী প্রত্যয়যোগে শব্দ গঠন
পুরুষবাচক শব্দের সঙ্গে কতগুলো প্রত্যয় (ঈ, নি, নী, আনী, ইনী, ন) যোগ করে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠন করা হয়। যেমন :
* ঈ-প্রত্যয়
বেঙ্গমা-বেঙ্গমী ভাগনা/ভাগনে-ভাগনী
* নী-প্রত্যয়
কামার-কামারনী জেলে-জেলেনী কুমার-কুমারনী ধোপা-ধোপানী মজুর-মজুরনী
আবার পুরুষবাচক শব্দের শেষে ঈ থাকলে স্ত্রীবাচক শব্দে নী হয় এবং এর আগের ঈ ই হয়। যেমন :
ভিখারি-ভিখারিনী অভিসারী-অভিসারিণী
* আনী-প্রত্যয়
ঠাকুর-ঠাকুরানী নাপিত-নাপিতানী মেথর-মেথরানী চাকর-চাকরানী
* ইনী- প্রত্যয়
কাঙাল-কাঙালিনী গোয়ালা-গোয়ালিনী বাঘ-বাঘিনী
* উন-প্রত্যয়
ঠাকুর-ঠাকরুন/ঠাকুরানী
* আইন-প্রত্যয় : নতুন নতুন প্রত্যয়ের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন
ঠাকুর-ঠাকুরাইন
সংস্কৃত স্ত্রী প্রত্যয়যোগে শব্দগঠন
তৎসম পুরুষবাচক শব্দের পরে আ, ঈ, আনী, নী, ইকা প্রভৃতি প্রত্যয়যোগে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন :
* আ-যোগে
ক. সাধারণ অর্থে
মৃত-মৃতা বিবাহিত-বিবাহিতা মাননীয়-মাননীয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রিয়-প্রিয়া প্রথম-প্রথমা চতুর-চতুরা চপল-চপলা নবীন-নবীনা কনিষ্ঠ-কনিষ্ঠা মলিন-মলিনা
খ. জাতি বা শ্রেণিবাচক
অজ-অজা কোকিল-কোকিলা শিষ্য-শিষ্যা ক্ষত্রিয়-ক্ষত্রিয়া শূদ্র-শূদ্রা
* ঈ-প্রত্যয় যোগে
ক. সাধারণ অর্থে
নিশাচর-নিশাচরী ভয়ংকর-ভয়ংকরী রজক-রজকী কিশোরী-কিশোরী
সুন্দর-সুন্দরী চতুর্দশ-চতুর্দশী ষোড়শ-ষোড়শী
খ. জাতি বা শ্রেণিবাচক
সিংহ-সিংহী ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী মানব-মানবী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী কুমার-কুমারী ময়ূর-ময়ূরী
* ইকা-প্রত্যয় যোগে
ক) যেসব শব্দের শেষে ‘অক্’ রয়েছে সেসব শব্দে ‘অক্’ স্থলে ‘ইকা’ হয়-
বালক-বালিকা নায়ক-নায়িকা গায়ক-গায়িকা সেবক-সেবিকা অধ্যাপক-অধ্যাপিকা
গণক-গণকী নর্তক-নর্তকী চাতক-চাতকী রজক-রজকী আর বাংলায় রজকিনী
খ) ক্ষুদ্রার্থে ইকা যোগ হয়-
নাটক-নাটিকা মালা-মালিকা গীত-গীতিকা পুস্তক-পুস্তিকা (এগুলো স্ত্রী প্রত্যয় নয়, ক্ষুদ্রার্থক প্রত্যয়)
* আনী-যোগ করে
ইন্দ্র-ইন্দ্রানী মাতুল-মাতুলানী আচার্য-আচার্যানী (কিন্তু আচার্যের কর্মে নিয়োজিত অর্থে আচার্য)
এরূপ : শূদ্র-শূদ্রা (শূদ্র জাতীয় স্ত্রীলোক শূদ্রানী (শূদ্রের স্ত্রী)), ক্ষত্রিয়-ক্ষত্রিয়া/ক্ষত্রিয়ানী ইত্যাদি
আনী কোনো কোনো সময় অর্থের পার্থক্য ঘটে। যেমন : অরণ্য-অরণ্যানী (বৃহৎ অরণ্য), হিম-হিমানী (জমানো বরফ)
* ঈনী, নী, যোগে
মায়াবী-মায়াবিনী কুহক-কুহকিনী যোগী-যোগিনী মেধাবী-মেধাবিনী দুঃখী- দুঃখিনী
বিশেষ নিয়মে সাধিত স্ত্রীবাচক শব্দগঠন
যেসব পুরুষবাচক শব্দের শেষে ‘তা’ রয়েছে, স্ত্রীবাচক বোঝাতে সেসব শব্দে ‘স্ত্রী’ হয়। যেমন :
নেতা-নেত্রী কর্তা-কর্ত্রী শ্রোতা-শ্রোত্রী ধাতা-ধাত্রী
পুরুষবাচক শব্দের শেষে অত্, বান্, মান্, ঈয়ান থাকলে যথাক্রমে অতী, বতী, মতি, ঈয়সী হয়। যেমন :
সৎ-সতী মহৎ-মহতী গুণবান-গুণবতী রূপবান-রূপবতী শ্রীমান-শ্রীমতী
বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী গরীয়ান-গরিয়সী
কোনো কোনো পুরুষবাচক শব্দ থেকে বিশেষ নিয়মে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন :
সম্রাট-সম্রাজ্ঞী রাজা-রানি যুবক-যুবতী শ্বশুর-শাশুড়ি নর-নারী বন্ধু-বান্ধবী দেবর-জা
শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী স্বামী-স্ত্রী পতি-পত্নী সভাপতি-সভানেত্রী
নিত্য স্ত্রীবাচক তৎসম শব্দগঠন
সতীন, অর্ধাঙ্গিনী, কুলটা, বিধবা, অসূর্যষ্পশ্যা, অরক্ষণীয়া, সপত্নী ইত্যাদি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য /জ্ঞাতব্য
বাংলায় কতগুলো তৎসম স্ত্রীবাচক শব্দের পরে আবার স্ত্রীবাচক প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন : অভাগা-অভাগী/ অভাগিনী, ননদাই-ননদিনী/ননদী ইত্যাদি।
তৎসম পুরুষবাচক বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে পুরুষবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত এবং স্ত্রীবাচক বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে স্ত্রীবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। যেমন : বিদ্বান লোক এবং বিদুষী নারী। এখানে ‘লোক’ পুরুষবাচক বিশেষ্য এবং ‘নারী’ স্ত্রীবাচক বিশেষ্য। ‘বিদ্বান’ পুরুষবাচক বিশেষণ এবং ‘বিদুষী’ স্ত্রীবাচক বিশেষণ। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের এ নিয়ম মানা হয় না। যেমন : সংস্কৃতে ‘সুন্দর বালক ও সুন্দরী বালিকা’ বাংলায় ‘সুন্দর বালক ও সুন্দর বালিকা’।
* কতগুলো বাংলা শব্দে পুরুষ ও স্ত্রী দুই বোঝায়। যেমন : জন, পাখি, শিশু, সন্তান, শিক্ষিত, গুরু ইত্যাদি।
* কতগুলো শব্দে কেবল পুরুষ বোঝায়। যেমন : কবিরাজ, ঢাকী, কৃতদার, অকৃতদার ইত্যাদি।
* কতগুলো শব্দ শুধু স্ত্রীবাচক হয়। যেমন : সতীন, সৎমা, সধবা ইত্যাদি।
* কিছু পুরুষবাচক শব্দের দুটি করে স্ত্রীবাচক শব্দ রয়েছে। যেমন :
দেবর-ননদ (দেবরের বোন) /জা (দেবরের স্ত্রী) ভাই-বোন এবং ভাবি (ভাইয়ের স্ত্রী)
শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী (শিক্ষিকা) (পেশা অর্থে) শিক্ষকপত্নী (শিক্ষকের স্ত্রী)
বন্ধু-বান্ধবী (মেয়ে বন্ধু) ও বন্ধুপত্নী (বন্ধুর স্ত্রী) দাদা-দিদি (বড় বোন) ও বৌদি (দাদার স্ত্রী)
* বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দের বিশেষণ স্ত্রীবাচক হয় না। যেমন :
সুন্দর বলদ-সুন্দর গাই, সুন্দর ছেলে-সুন্দর মেয়ে, মেজ খুড়ো-মেজ খুড়ি
* বিধেয় বিশেষণ অর্থাৎ বিশেষ্যের পরবর্তী বিশেষণও স্ত্রীবাচক হয় না। যেমন :
মেয়েটি পাগল হয়ে গেছে (পাগলি হয়ে গেছে হবে না)। আসমা ভয়ে অস্থির (অস্থিরা হবে না)
* কুল-উপাধিরও স্ত্রীবাচকতা রয়েছে। যেমন : ঘোষ (পুরুষ) - ঘোষজা (কন্যা অর্থে) /ঘোষজায়া (পত্নী অর্থে)
দ্বিরুক্ত শব্দের সংজ্ঞা ও প্রকরণ
দ্বিরুক্ত অর্থ দুবার উক্ত হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় কোনো কোনো শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো দুইবার ব্যবহার করলে অন্য কোনো সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে। এ ধরনের শব্দের পরপর দুইবার প্রয়োগেই দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হয়। যেমন : আমার জ্বর জ্বর লাগছে। অর্থাৎ ঠিক জ্বর নয়, জ্বরের ভাব অর্থে এই প্রয়োগ।
দ্বিরুক্ত শব্দ নানা রকম হতে পারে। যেমন :
ক. শব্দের দ্বিরুক্তি : শব্দে যে দ্বিরুক্ত ব্যবহার করা হয় তাকে শব্দের দিরুক্তি বলে।
খ. পদের দ্বিরুক্তি : পদে যে দ্বিরুক্ত ব্যবহার করা হয় তাকে শব্দের দিরুক্তি বলে।
গ. ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি : কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।
শব্দের দ্বিরুক্তি
শব্দের দ্বিরুক্তির কিছু নিয়ম :
১. একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করা হয় এবং শব্দ দুটি অবিকৃত থাকে। যেমন : ভালো ভালো ফল, ফোঁটা ফোঁটা পানি, বড় বড় বই
২. একই শব্দের সঙ্গে সমার্থক আর একটি শব্দ যোগ করে ব্যবহৃত হয়। যেমন : ধনদৌলত, খেলাধুলা, লালন-পালন, বলা-কওয়া, খোঁজখবর
৩. দ্বিরুক্ত শব্দ-জোড়ার দ্বিতীয় শব্দটির আংশিক পরিবর্তন হয়। যেমন : মিটমাট, ফিটফাট, বকাঝকা, তোড়জোড়, গল্পসল্প, রকম-সকম
৪. সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দ যোগে: যেমন: লেনদেন, দেনাপাওনা, টাকাপয়সা, ধনীগরিব, আসাযাওয়া
যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত শব্দের গঠন
একই শব্দ ঈষৎ পরিবর্তন করে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠনের রীতিকে বলে যুগ্মরীতি। যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত গঠনের কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। যেমন :
১. শব্দের আদি স্বরের পরিবর্তন করে : চুপচাপ, মিটমাট, জারিজুরি
২. শব্দের অন্ত্যস্বরের পরিবর্তন করে : মারামারি, হাতাহাতি, সরাসরি, জেদাজেদি
৩. দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সময় ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তনে : ছটফট, নিশপিশ, ভাতটাত
৪. সমার্থক বা একার্থক সহচর শব্দ যোগে : চালচলন, রীতিনীতি, বনজঙ্গল, ভয়ডর
৫. ভিন্নার্থক শব্দ যোগে : ডালভাত, তালাচাবি, পথঘাট, অলিগলি
৬. বিপরীতার্থক শব্দ যোগে : ছোটবড়, আসা-যাওয়া, জন্মমৃত্যু, আদানপ্রদান
বিশিষ্টার্থক বাগধারায় দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ
সতর্কতা : ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো।
ভাবের প্রগাঢ়তা : ফুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা।
কালের বিস্তার : থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে।
আধিক্য : লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান। খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে, পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে যায়।
পদের দ্বিরুক্তি
পদের দ্বিরুক্তির কিছু নিয়ম
১. দুটি পদে একই বিভক্তি প্রয়োগ করা হয়, শব্দ দুটি ও বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন :
ঘরে ঘরে লেখাপড়া হলো। দেশে দেশে ধন্য ধন্য করতে লাগল। মনে মনে আমিও এ কথাই ভেবেছি।
২. দ্বিতীয় পদের আংশিক ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটে কিন্তু পদবিভক্তি অবিকৃত থাকে। যেমন :
চোর হাতে নাতে ধরা পড়েছে। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
পদের দ্বিরুক্তির প্রয়োগ
বিভিন্নভাবে পদের দ্বিরুক্তি হতে পারে। যেমন:
ক. বিশেষ্য শব্দযুগলের বিশেষণরূপে ব্যবহার
১. আধিক্য বোঝাতে : রাশি রাশি ধান, ধামা ধামা ধান।
২. সামান্য বোঝাতে : আমি আজ জ্বর জ্বর বোধ করছি। দেখেছ তার কবি কবি ভাব।
৩. পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে : তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ। তুমি বাড়ি বাড়ি হেঁটে চাঁদা তুলেছ।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ : ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায়।
৫. অনুরূপ কিছু বোঝাতে : তার সঙ্গী সাথী কেউ নেই।
৬. আগ্রহ বোঝাতে : ও দাদা দাদা বলে কাঁদছে।
খ. বিশেষণ শব্দযুগলের বিশেষণ রূপে ব্যবহার
১. আধিক্য বোঝাতে : ভালো ভালো আম নিয়ে এসো। ছোট ছোট ডাল কেটে ফেল।
২. তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতে : গরম গরম জিলাপি, নরম নরম হাত।
৩. সামান্যতা বোঝাতে : উড়– উড়– ভাব, কালো কালো চেহারা।
গ. সর্বনাম শব্দ
বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে : সে সে লোক গেল কোথায়? কে কে এলো? কেউ কেউ বলে।
ঘ. ক্রিয়াবাচক শব্দ
১. বিশেষণ রূপে : এদিকে রুগির তো যায় যায় অবস্থা। তোমার নেই নেই ভাব গেল না।
২. স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে : দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে এলো।
৩. ক্রিয়া বিশেষণ : দেখে দেখে যেও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কীভাবে?
৪. পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে : ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছি।
ঙ. অব্যয়ের দ্বিরুক্তি
১. ভাবের গভীরতা বোঝাতে : তার দুঃখ দেখে সবাই হায় হায় করতে লাগল। ছি ছি, তুমি কী করেছ?
২. পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে : বার বার সে কামান গর্জে উঠল।
৩. অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে : ভয়ে গা ছম ছম করছে। ফোঁড়াটা টন টন করছে।
৪. বিশেষণ বোঝাতে : পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
৫. ধ্বনিব্যঞ্জনা : ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।
পদাত্মক দ্বিরুক্তি
বিভক্তিযুক্ত পদের দুইবার ব্যবহারকে পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলা হয়। এগুলো দুই রকমে গঠিত হয়। যেমন :
১. একই পদের অবিকৃত অবস্থায় দুইবার ব্যবহার। যেমন: ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। হাটে হাটে বিকিয়ে তোর ভরা আপন।
২. যুগ্মরীতিতে গঠিত দ্বিরক্ত পদের ব্যবহার। যেমন : হাতেনাতে, আকাশে-বাতাসে, কাপড়-চোপড়, দলেবলে
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে। এ জাতীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুইবার প্রয়োগের নাম ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব, আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরক্তি শব্দ কয়েকটি উপায়ে গঠিত হয়। যেমন :
১. মানুষের ধ্বনির অনুকার : ভেউ ভেউ-মানুষের উচ্চস্বরে কান্নার ধ্বনি ট্যা ট্যা হি হি
২. জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকার : ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ধ্বনি) মিউ মিউ (বিড়ালের ডাক)
কুহু কুহু (কোকিলের ডাক) কা কা (কাকের ডাক)
৩. বস্তুর ধ্বনির অনুকার : ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ) মড়মড় (গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ)
ঝমঝম (বৃষ্টি পড়ার শব্দ) হু হু (বাতাস প্রবাহের শব্দ)
৪. অনুভূতিজাত কাল্পনিক ধ্বনির অনুকার : ঝিকিমিকি (উজ্জ্বল্য)। ঠা ঠা (রোদের তীব্রতা), কুট কুট (শরীরে কামড় লাগার মতো অনুভূতি) মিনমিন, পিটপিট, ঝি ঝি
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন
১. একই (ধ্বন্যাত্মক) শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ : ধবধব, ঝনঝন, পটপট্
২. প্রথম শব্দটির শেষে আ যোগ করে : গপাগপ, টপটপ, পটাপট
৩. দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ই যোগ করে : ধরাধরি, ঝমঝমি, ঝনঝনি
৪. যুগ্মরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ : কিচিরমিচির (পাখি বা বানরের শব্দ) টাপুর টুপুর (বৃষ্টি পতনের শব্দ)
হাপুসহুপুস (গোগ্রাসে কিছু খাওয়ার শব্দ)
৫. আনি-প্রত্যয় যোগেও বিশেষ্য দ্বিরুক্তি গঠিত হয় : পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়।
তোমার বকবকানি আর ভালো লাগে না।
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার (বিভিন্ন পদরূপে)
১. বিশেষ্য : বৃষ্টির ঝমঝমানি আমাদের অস্থির করে তোলে।
২. বিশেষণ : নামিল নভে বাদল ছলছল বেদনায়।
৩. ক্রিয়া : কলকলিয়ে উঠল সেথায় নারীর প্রতিবাদ।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ : চিকচিক করে বালি কোথা নাহি কাদা।
সংখ্যাবাচক শব্দের সংজ্ঞা ও প্রকরণ
সংখ্যা মানে গণনা বা গণনা দ্বারা লব্ধ ধারণা। সংখ্যা গণনার মূল একক ‘এক’। কাজেই সংখ্যাবাচক শব্দে এক, একাধিক, প্রথম, প্রাথমিক ইত্যাদির ধারণা করতে পারি। যেমন : এক টাকা, দশ টাকা। এক টাকাকে এক এক করে দশবার নিলে হয় দশ টাকা।
সংখ্যাবাচক শব্দ চার প্রকার। যেমন :
১. অঙ্কবাচক সংখ্যা ২. পরিমাণ বা গণনাবাচক সংখ্যা ৩. ক্রমবাচক সংখ্যা ৪. তারিখবাচক শব্দ
অঙ্কবাচক সংখ্যা
‘তিন টাকা’ বলতে এক টাকার তিনটি একক বা এককের সমষ্টি বোঝায়।আমাদের একক হলো ‘এক’। সুতরাং এক+এক+এক=তিন। এভাবে আমরা এক থেকে একশ পর্যন্ত গণনা করতে পারি। এক থেকে একশ পর্যন্ত এভাবে গণনার পদ্ধতিকে বলা হয় দশ গুণোত্তর পদ্ধতি। এক থেকে দশ পর্যন্ত আমরা এভাবে লিখে থাকি। যেমন : এক (১), দুই (২), তিন (৩), চার (৪), পাঁচ (৫), ছয় (৬), সাত (৭), আট (৮), নয় (৯), দশ (১০)।
এখানে যেসব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে তাদের বলে অঙ্ক। এক থেকে নয় পর্যন্ত অঙ্কে লিখিত। দশ লিখতে এক লিখে তার ডানে একটি শূন্য (১০) দিতে হয়। এই শূন্যের অর্থ বাম দিকে লিখিত পূর্ণ সংখ্যাটির দশগুণ। এটিই দশ গুণোত্তর প্রণালীর নিয়ম।
এ ধরনের প্রতিটি ‘দশ’ কে একক ধরে আমরা বিশ বা কুড়ি (২০), ত্রিশ (৩০), চল্লিশ (৪০), পঞ্চাশ (৫০), ষাট (৬০), সত্তর (৭০), আশি (৮০), নব্বই (৯০), পর্যন্ত গণনা করি। তারপরের দশকের একককে বলা হয় একশ (১০০)।
এভাবে আমরা দশের গুণন ও এককের সংকলন করে বিভিন্ন সংখ্যা লিখে থাকি। যেমন :
এক দশ+এক=এগার (১০+১ =১১), এক দশ চার=চৌদ্দ (১০+৪=১৪) ইত্যাদি।
এভাবে দশকের ঘরে দুই (২) হলে বলি দুই দশ=বিশ (১০+১০= ২০) ও দুই দশ এক=একুশ (১০+১০+১=২১)।
এরূপ: তিন দশ+এক=একত্রিশ, চার দশ+এক=একচল্লিশ ইত্যাদি।
পরিমাণ বা গণনা বাচক সংখ্যা
একাধিকবার একই একক গণনা করলে যে সমষ্টি পাওয়া যায় তাই পরিমাণ বা গণনাবাচক সংখ্যা। যেমন : সপ্তাহ বলতে আমরা সাত দিনের সমষ্টি বুঝিয়ে থাকি। সপ্ত (সাত) + অহ (দিনক্ষণ)=সপ্তাহ। এখানে দিন একটি একক।
এরূপ : সাতটি দিন বা সাতটি একক মিলে হয়েছে সপ্তাহ।
পূর্ণসংখ্যার গুণবাচক সংখ্যা
একগুণ=এক। যেমন : একেক্কে এক (অর্থাৎ ১X১=১)।
এরূপ : দুয়েক্কে দুই, সাতেক্কে সাত ইত্যাদি। দুই গুণ-দ্বিগুণ বা দুগুণ। যেমন : দুই দু গুণে চার (২X2=৪)।
এরূপ : পাঁচ দু গুণে দশ (৫X২=১০), সাত দু গুণে চৌদ্দ (৭X২=১৪)। তিন গুণ=তিরিক্কে। যেমন : তিন তিরিক্কে নয় (৩X৩=৯)
চার গুণ=চার বা চৌকা। যেমন : তিন চারে বা চৌকা বার (৩X৪=১২)
পাঁচ গুণ=পাঁচা। যেমন : পাঁচ পাঁচা পঁচিশ (৫X৫=২৫)
ছয় গুণ=ছয়ে। যেমন : তিন ছয়ে আঠার (৩X৬=১৮)
সাত গুণ=সাতা। যেমন : তিন সাতা একুশ (৩X৭=২১)
আট গুণ=আটা। যেমন: তিন আটা (বা তে আটা) চব্বিশ (৩X৮=২৪)
নয় গুণ=নং বা নয়। যেমন : তিন নং (বা তিন নয়) সাতাশ (৩X৯=২৭)
দশ গুণ=দশং বা দশ। যেমন : তিন বিশং (বা তিন দশে) ত্রিশ (৩X১০=৩০)
বিশ গুণ=বিশং বা বিশ। যেমন : তিন বিশং (বা তিন বিশ) ষাট (৩X২০=৬০)
ত্রিশ গুণ=ত্রিশং বা ত্রিশ। যেমন : তিন ত্রিশং (বা তিন ত্রিশ) নব্বই (৩X৩০=৯০)
এরূপ : চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, বা শ’-এর পূরণবাচক সংখ্যা গণনা করা হয়।
পূর্ণসংখ্যার ন্যূনতা বা আধিক্য বাচক ‘সংখ্যা শব্দ’ (ক) ন্যূন
এক এককের চার ভাগের এক ভাগ ১/৪ = চৌথা, সিকি বা পোয়া
’’ ’’ তিন ভাগের এক ভাগ ১/৩ = তেহাই
’’ ’’ দুই ভাগের এক ভাগ ১/২ = অর্ধ বা আধা
’’ ’’ আট ভাগের এক ভাগ ১/৮ = আট ভাগের একক বা এক অষ্টমাংশ
তেমনি এক পঞ্চমাংশ (১/৫)
এক দশমাংশ (১/১০)
এ সবের আরও ভাঙতি হলে
চার ভাগের তিন (৩/৪)=তিন চতুর্থাংশ
আট ভাগের তিন (৩/৮)=তিন অষ্টমাংশ
এক এককের (৩/৪) কে পরবর্তী সংখ্যার পৌনে বলা হয়। যেমন : পৌনে তিন (২/৩/৪) পৌনে ছয় (৫/৩/৪)
পৌনে অর্থ পোয়া অংশ বা এক চতুর্থাংশ (১/৪) কম অর্থাৎ পৌনে=(১-১/৪)=৩/৪
সওয়া=১/১/৪ (সওয়া বা সোয়া এক)
দেড়=১/১২=১/২ কম ২
আড়াই=২/১/২=১/২ কম ৩
এগুলো ছাড়া অর্ধযুক্ত থাকলে সর্বত্র ‘সাড়ে’ বলা হয়। যেমন : ৩/১/২=সাড়ে তিন, ৪/১/২=সাড়ে চার ইত্যাদি।
ক্রমবাচক সংখ্যা
একই সারি, দল বা শ্যেলিতে অবস্থিত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যার ক্রম বা পর্যায় বোঝাতে ক্রম বা পূরণবাচক সংখ্যা ব্যবহৃত হয়। যেমন: দ্বিতীয় লোকটিকে ডাক। এখানে গণনার একজনের পরের লোকটিকে বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় লোকটির আগের লোকটিকে বলা হয় ‘প্রথম’ এবং প্রথম লোকটি পরের লোকটিকে বলা হয় ‘দ্বিতীয়’। এরূপ : তৃতীয়, চতুর্থ ইত্যাদি।
তারিখবাচক শব্দ
বাংলা মাসের তারিখ বোঝাতে যে সংখ্যাবাচক শব্দ ব্যবহৃত হয় তাকে তারিখবাচক শব্দ বলে। যেমন : পয়লা বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ।
তারিখবাচক শব্দের প্রথম চারটি অর্থাৎ ১ থেকে ৪ পর্যন্ত হিন্দি নিয়মে সাধিত হয়। বাকি শব্দ বাংলার নিজস্ব ভঙ্গিতে গঠিত। নিচে বাংলা অঙ্কবাচক, গণনাবাচক, পূরণবাচক ও তারিখবাচক সংখ্যাগুলো দেওয়া হলো :
অঙ্ক/সংখ্যা গণনাবাচক পূরণবাচক তারিখবাচক
১ এক প্রথম পহেলা (হিন্দি)
২ দুই দ্বিতীয় দোসরা (হিন্দি)
৩ তিন তৃতীয় তেসরা (হিন্দি)
৪ চার চতুর্থ চৌঠা (হিন্দি)
৫ পাঁচ পঞ্চম পাঁচই
৬ ছয় ষষ্ঠ ছয়ই
৭ সাত সপ্তম সাতই
৮ আট অষ্টম আটই
৯ নয় নবম নয়ই
১০ দশ দশম দশই
১১ এগার একাদশ এগারই
১২ বার দ্বাদশ বারই
১৩ তের ত্রয়োদশ তেরই
১৪ চৌদ্দ চতুর্দশ চৌদ্দই
১৫ পনের পঞ্চদশ পনেরই
১৬ উনিশ উনবিংশ উনিশে
১৭ বিশ/কুড়ি বিংশ বিশে
১৮ একুশ একবিংশ একুশে
বচনের সংজ্ঞা ও প্রকরণ
বচন’ ব্যাকরণের একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ সংখ্যার ধারণা। ব্যাকরণে বিশেষ্য বা সর্বনামের সংখ্যাগত ধারণা প্রকাশের উপায়কে বলে বচন।
বাংলা ভাষায় বচন দুই প্রকার। যেমন :
১. একবচন
যে শব্দ দ্বারা কোনো প্রাণী, বস্তু বা ব্যক্তির একটিমাত্র সংখ্যার ধারণা হয় তাকে একবচন বলে। যেমন : সে এলো। মেয়েটি স্কুলে যায়নি।
২. বহুবচন
যে শব্দ দ্বারা কোনো প্রাণী, বস্তু বা ব্যক্তির একের অধিক অর্থাৎ বহু সংখ্যার ধারণা হয় তাকে বহুবচন বলে। যেমন : তারা গেল। মেয়েরা এখনও আসেনি।
বচনের গঠন
* শুধু বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের বচনভেদে হয়। কোনো কোনো সময় টা, টি, খানা, খানি ইত্যাদি যোগ করে বিশেষ্যের একবচন নির্দেশ করা হয়। যেমন : গরুটা, বাছুরটা, কলমটা, খাতাখানা, বইখানি ইত্যাদি।
* বাংলায় বহুবচন প্রকাশের জন্য রা, এরা, গুলা, গুলি, গুলো, দিগ, দের প্রভৃতি বিভক্তি যুক্ত হয় এবং সব, সকল, সমুদয়, কূল, বৃন্দ, বর্গ, নিচয়, রাজি, রাশি, পাল, দাম, নিকর, মালা, আবলি প্রভৃতি সমষ্টিবোধক শব্দ ব্যবহৃত হয়। সমষ্টিবোধক শব্দগুলোর বেশিরভাগই তৎসম বা সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত।
* প্রাণিবাচক, অপ্রাণিবাচক, ইতর প্রাণিবাচক ও উন্নত প্রাণিবাচক শব্দভেদে বিভিন্ন ধরনের বহু বচনবোধক প্রত্যয় ও সমষ্টিবোধক শব্দ যুক্ত হয়। যেমন :
রা : কেবল উন্নত প্রাণিবাচক শব্দের সঙ্গে ‘রা’ বিভক্তির ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন : ছাত্ররা খেলা দেখতে গেছে। তারা সকলেই লেখাপড়া করে। শিক্ষকেরা জ্ঞান দান করেন। যে ধরনের শব্দে ‘রা’ যুক্ত, সে ধরনের শব্দের শেষে কোনো কোনো সময় ‘এরা’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : মেয়েরা ঝিয়েরা একত্র হয়েছে। সময় সময় কবিতা বা অন্যান্য প্রয়োজনে অপ্রাণী ও ইতর প্রাণিবাচক শব্দেও রা, এরা যুক্ত হয়। যেমন : ‘পাখিরা আকাশে উড়ে দেখিয়া হিংসায় পিপীলিকারা বিধাতার কাছে পাখা চায়।’ কাকেরা এক বিরাট সভা করল। (যদিও ব্যক্তি বাদে প্রাণী বা বস্তুবাচক শব্দের (পাখি, গরু, মেঘ) সাথে ‘রা’ ব্যবহৃত হয় না তবুও করা হয়)
গুলা, গুলি, গুলো : এগুলো প্রাণিবাচক ও অপ্রাণিবাচক শব্দের বহুবচনে যুক্ত হয়। যেমন : অতগুলো কুমড়া দিয়ে কী হবে? আমগুলো টক। টাকাগুলো দিয়ে দাও। ময়ূরগুলো পুচ্ছ নাড়িয়ে নাচছে।
উন্নত প্রাণিবাচক মনুষ্য শব্দের বহুবচনে ব্যবহৃত শব্দ
গণ-দেবগণ, নরগণ, জনগণ
বৃন্দ-সুধীবৃন্দ, ভক্তবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ
মণ্ডলী-শিক্ষকমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী
বর্গ-পণ্ডিতবর্গ, মন্ত্রিবর্গ
প্রাণিবাচক ও অপ্রাণিবাচক শব্দে বহুবচনে ব্যবহৃত শব্দ
কুল-কবিকুল, পক্ষিকুল, মাতৃকুল, বৃক্ষকুল
সকল-পর্বতসকল, মনুষ্যসকল
সব-ভাইসব, পাখিসব
সমূহ-বৃক্ষসমূহ, মনুষ্যসমূহ
অপ্রাণিবাচক শব্দে ব্যবহৃত বহুবচনবোধক শব্দ
আবলি, গুচ্ছ, দাম, নিকর, পুঞ্জ, মালা, রাজি, রাশি ইত্যাদি অপ্রাণিবাচক বহুবচনে ব্যবহৃত হয়। যেমন : গ্রন্থাগারে রক্ষিত পুস্তকাবলি, কবিতাগুচ্ছ, কুসুমদাম, কমলনিকর, মেঘকুঞ্জ, পর্বতমালা, তারকারাজি, বালিরাশি, কুসুম ইত্যাদি।
বহুবচনের প্রয়োগ বৈশিষ্ট্য
ক) বিশেষ্য শব্দের একবচনের ব্যবহারেও অনেক সময় বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন :
সিংহ বনে থাকে। (একবচন ও বহুবচন দুই বোঝায়) পোকার আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়। (বহুবচন)
বাজারে লোক জমেছে। (বহুবচন) বাগানে ফুল ফুটেছে। (বহুবচন)
খ) একবচনাত্মক বিশেষ্যের আগে অজস্র, অনেক, বিস্তর, বহু, নানা, ঢের ইত্যাদি বহুত্ববোধক শব্দ বিশেষণ হিসেবে প্রয়োগ করেও বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন :
অজস্র লোক। অনেক ছাত্র। বিস্তর টাকা। বহু মেহমান।
নানা কথা। ঢের খরচ। অঢেল টাকা পয়সা।
গ) অনেক সময় বিশেষ্য ও বিশেষণ পদের দ্বিত্ব প্রয়োগেও বহুবচন সাধিত হয়। যেমন :
হাঁড়ি হাঁড়ি সন্দেশ। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বড় বড় মাঠ। লাল লাল ফুল।
ঘ) বিশেষ নিয়মে সাধিত বহুবচন। বহুবাচক সর্বনাম ও বিশেষ্য :
মেয়েরা কানাকানি করছে। এটাই করিমদের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথরা প্রতিদিন জন্মায় না। সকলে সব জানে না।
ঙ) কতিপয় বিদেশি শব্দে, সে ভাষার অনুসরণে বহুবচন হয়। যেমন :
আন যোগে : বুজুর্গ-বুজুর্গান সাহেব-সাহেবান
বিশেষ দ্রষ্টব্য
* পাল ও যূথ শব্দ দুটি কেবল জন্তুর বহুবচনে ব্যবহৃত হয়। যেমন :
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। হস্তিযূথ মাঠের ফসল নষ্ট করছে।
* ওপরে বর্ণিত বহুবচনবোধক প্রত্যয় ও সমষ্টিবোধক শব্দের অধিকাংশই তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত এবং সে কারণে অধিকাংশই সাধুরীতি ও সংস্কৃত শব্দে প্রযোজ্য। খাঁটি বাংলা শব্দের বহুবচনে এবং চলিত রীতিতে ‘রা, এরা, গুলা, গুলো, দের’ ইত্যাদি প্রত্যয় এবং ‘অনেক, বহু, সব’ এসব শব্দের ব্যবহারই বহুল প্রচলিত।
* একই সঙ্গে দুইবার বহুবচনবাচক প্রত্যয় বা শব্দ ব্যবহৃত হয় না। যেমন :
সব মানুষই অথবা মানুষ অথবা মানুষেরা মরণশীল (শুদ্ধ)। সকল মানুষেরাই মরণশীল (ভুল)।
* গুলো বহুবচনজাতীয় চিহ্ন তাই এর সাথে ‘কে’ (একবচন) বসে না। যেমন: এগুলোকে, তাদেরকে, আমাদেরকে ইত্যাদি।
পদাশ্রিত নির্দেশকের সংজ্ঞা ও প্রকরণ
কয়েকটি অব্যয় বা প্রত্যয় কোনো না কোনো পদের আশ্রয়ে বা পরে সংযুক্ত হয়ে নির্দিষ্টতা জ্ঞাপন করে। এদের পদাশ্রিত অব্যয় বা পদাশ্রিত নির্দেশক বলে। বাংলায় নির্দিষ্টতা জ্ঞাপক প্রত্যয় ইংরেজি Definite Article 'The' - এর স্থানীয়। বচনভেদে পদাশ্রিত নির্দেশকেরও বিভিন্নতা প্রযুক্ত হয়।
নির্দেশক সংখ্যা নির্দেশ করে তাই সংখ্যার দিক দিয়ে নির্দেশক দুই প্রকার। যেমন :
১. একবচন : টা, টি, খানা, খানি, গাছা, গাছি ইত্যাদি নির্দেশক ব্যবহৃত হয়। যেমন :
টাকাটা বাড়িটা কাপড়খানা বইখানি লাঠিগাছা চুড়িগাছি
২. বহুবচন : গুলি, গুলা, গুলো, গুলিন প্রভৃতি নির্দেশক প্রত্যয় সংযুক্ত হয়। যেমন:
মানুষগুলি লোকগুলো আমগুলো পটলগুলিন
পদাশ্রিত নির্দেশকের ব্যবহার
টা বা টি
* শব্দের সঙ্গে টা বা টি যুক্ত হলে অনির্দিষ্টতা বোঝায়। যেমন: একটি দেশ, সে যেমনই হোক দেখতে। কিন্তু অন্য সংখ্যাবাচক শব্দের সাথে টা বা টি যুক্ত হলে নির্দিষ্টতা বোঝায়। যেমন : তিনটি টাকা, দশটি বছর।
* নিরর্থকভাবেও নির্দেশক টা বা টির ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন: সারাটি সকাল তোমার আশায় বসে আছি। ন্যাকামিটা এখন রাখ।
* নির্দেশক সর্বনামের পরে টা বা টি যুক্ত হলে তা সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন : ওটি যেন কার তৈরি? এটা নয় ওটা আন। সেইটেই ছিল আমার প্রিয় কলম।
গোটা ও খানা
* ‘গোটা’ বচনবাচক শব্দটির আগে বসে এবং খানা, খানি পরে বসে। এগুলো নির্দেশক ও অনির্দেশক দুই অর্থেই প্রযোজ্য। ‘গোটা’ শব্দ আগে বসে এবং সংশ্লিষ্ট পদটি নির্দিষ্টতা না বুঝিয়ে অনির্দিষ্টতা বোঝায়। যেমন : গোটা দেশই ছারখার হয়ে গেছে। গোটাদুই কমলালেবু আছে (অনির্দিষ্ট)। গোটাসাতেক আম এনো।
* দুখানা কম্বল চেয়েছিলাম (নির্দিষ্ট)। একখানা বই কিনে নিও (অনির্দিষ্ট)। কিন্তু কবিতায় বিশেষ অর্থে ‘খানি’ নির্দিষ্টার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : ‘আমি অভাগা এনেছি বহিয়া নয়ন জলে ব্যর্থ সাধনখানি।
টাক, টুক, টুকু, টো
* টাক, টুক, টুকু, টো ইত্যাদি পদাশ্রিত নির্দেশক নির্দিষ্টতা ও অনির্দিষ্টতা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যেমন : পোয়াটাক দুধ দাও (অনির্দিষ্টতা)। সবটুকু ওষুধই খেয়ে ফেলো (নির্দিষ্টতা)।
বিশেষ অর্থে
বিশেষ অর্থে নির্দিষ্টতা জ্ঞাপনে ‘কেতা, তা, পাটি’ ব্যবহৃত হয়। যেমন :
কেতা : এ তিনকেতা জমির দাম দশ হাজার টাকা মাত্র। দশ টাকার পাঁচকেতা নোট।
তা : দশ তা কাগজ দাও।
পাটি : আমার একপাটি জুতো ছিঁড়ে গেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই, ঐ, ও, ইত্যাদি নির্দেশক বসলে পরের শব্দের পরে টি/টা/খানা/খানি বসে না। যেমন : এই কাজটি, এই উক্তিটি, ওই বইখানা ইত্যাদি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন